বিপদবন্ধু সাংবাদিক কার প্রতিপক্ষ
।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী ।।
ভাবুনতো, দেশে কোনো ধরনের সংবাদমাধ্যম নেই। ফলে কি ঘটতে পারে। সরকার নিত্যদিন কি করছে তা জনগণ জানতে পারছে না। জনগণের মধ্যে কি হচ্ছে তাও কেউ জানছে না। অতি আধুনিক এ সময়ে এমন চিন্তা করাটাও হাস্যকর। জীবন ও জগত জানার তীব্র আকাঙ্খা বা বাসনা থেকেই জন্ম নেয় চিন্তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বাহনই হচ্ছে সংবাদ- গণমাধ্যম। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি সর্বজনীন। আর গণমাধ্যমের প্রাণ সাংবাদিক।
যে কোনো কাজেরই প্রধান দু’টি পক্ষ। পক্ষ আর বিপক্ষ। সৃষ্ট সংবাদ নিজেই একটি পক্ষ। তাই তার প্রতিপক্ষ নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো সংবাদ কি সাংবাদিক সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই না। রাষ্ট্র, গোষ্ঠী, শ্রেণি- ব্যক্তিমানুষ সংবাদ সৃষ্টি বা তৈরি করেন। সেই সংবাদ একজন সাংবাদিক উপস্থাপন করেন মাত্র। যাকে তুলে আনা বলা যায়। সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করেন। পরিপাটি করে, ঘটনার বাস্তব সততা ঠিক রেখে- যা ঘটছে তাই শালীনতা বজায় রেখে পাঠযোগ্য করে পরিবেশন করেন। খামখেয়ালি করতে পারেন না। এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পারে। কারণ সাংবাদিকের কাজের সাথে দায়িত্বশীলতা জড়িত।
গ্রামের দশ হাজার মানুষ পাকা ব্রিজের অভাবে দুর্ভোগের শিকার। আর জনদুর্ভোগ থেকেই সংবাদের সৃষ্টি বা জন্ম। জনপ্রতিনিধির কারণে এই জনদুর্ভোগ। সাংবাদিক ছবিসহ ওই সংবাদ পরিবেশন করেছে। এতে এলাকার জনপ্রতিনিধি ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের ব্যর্থতা সমাজে প্রকাশ পেয়েছে। তারা সমাজে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তখনই সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ ভাবেন। দাঁড় করিয়ে দেন কাঠগড়ায়। এভাবেই জনদুর্ভোগ বা জনস্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে সাংবাদিক প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। সাংবাদিকতা হচ্ছে সাংবাদিকের কাজ। ওই কাজই ব্যক্তি সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ বানায়।
সাংবাদিক বিপদের বন্ধু। সাধারণ মানুষ থেকে মহা ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতার বিপদের আশ্রয়স্থল সাংবাদিক। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই বিপদে পড়লে প্রথম খোঁজেন সাংবাদিককে। কারণ বিপদে সাংবাদিক উদ্ধার করতে না পারলেও অন্তত উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন, এটা সবাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সাংবাদিককে রাজনৈতিক নেতা যখন শায়েস্তা করেন, দলীয় ক্যাডাররা বা পুলিশ যখন পেটায়, রাস্তায় যখন মার খান তখন সবাই নিশ্চুপ বনে যান।
যে সাংবাদিক সবার অন্যায়, অধিকার আদায় ও বিচারের দাবি তুলে ধরেন, সেই সাংবাদিক আহত বা নিহত হয়ে অধিকার হারা হলে অন্য পেশার মানুষ এসে দাঁড়ায় না, কেউ পাশে থাকেন না। একা অসহায় আহত সাংবাদিক বা নিহতের পরিবারকেই লড়াইয়ে টিকে থাকতে হয়। উল্টো যখন অপবাদের ঢালি সাজিয়ে ঢুগঢুগি বাজান তখনও সবাই মজা নেন, বলে বেড়ান ‘ তাই নাকি’। সাংবাদিকের সাথে এ বন্ধুত্ব ক্ষণস্থায়ী, স্বার্থ ও সুবিধাবাদীতার পাপে আক্রান্ত। এমন নির্মম বাস্তবতায়ও সাংবাদিকতা থেমে নেই, নির্ভীক।
আমাদের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তা নিয়ে বির্তক আছে। এই সীমিত সাধ ও সাধ্যের মধ্যে গণমাধ্যমই একচেটিয়া বর্তমান ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের সুশাসনকে টিকিয়ে রাখতে পথ আগলে দৃঢ়তায় আলোক বর্তিকার ভূমিকায় চলছে। কারণ এখন খাম খাম রোগে আক্রান্ত সবাই। সব সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে। সব পেটে ঢুকে যাচ্ছে। মানবতা ও সৃজনশীলতার আড়ালে দুর্বৃত্তরা পড়ে আছে ভদ্র লেবাস মুখোশ। গণমাধ্যমই বাহবা দিচ্ছে, যতক্ষণ সাধারণ মানুষও দিচ্ছে। আবার মুখোশ ঝরে পরলে গর্ত থেকে সেই বিষধর সাপকেও তুলে আনছে গণমাধ্যমই। তারা কেবল ভয় করে সাংবাদিককের চোখ আর ক্যামেরাকে। আর এই হজম করার পথে প্রধান বাধা- অন্তরায় গণমাধ্যম। অতএব সাংবাদিকরাই শত্রু, তারাই প্রতিপক্ষ।
মুশকিল হলো, মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতার নেতা, এমনকি সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা পর্যন্ত মনে করেন সাংবাদিকরা কেবল তাদের প্রশংসা তুলে ধরবে। ভালো কথাগুলো লিখবে। ব্রিজ, হাসপাতাল নির্মাণের উপকারীতার বর্ণনা দিবে। কিন্তু এসব নির্মাণে লুটপাট হলো, দায়িত্বে অবহেলা থাকলো, মানুষ চায় নি এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলো- যা সংবাদ তা তুলে ধরলেই বিপত্তির শুরু। এসব আর্থিক বিষয়। এসব নাকি দেখবে শুধু দুদুকসহ সরকারি সংস্থা। সাংবাদিক এসব দেখার কে। রাষ্ট্রীয় অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তার হিসাব জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এসবে অপরাধ -দুর্নীতি করলে তাও জানতে চায় জনতা। জনতার এই জানতে চাওয়াকে পূরণ করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন আর গণমাধ্যম থাকে না। হয়ে যায় সরকার বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রচার মাধ্যমে। আমাদের গণমাধ্যমকে এখন প্রতিনিয়ত সেই লড়াই করে যেতে হচ্ছে।
সাংবাদিকতার মূল প্রতিপক্ষ ছিল রাষ্ট্র নিজেই। রাষ্ট্রও জানে তার সব কর্যক্রমে নজর রাখে গণমাধ্যম। তাই ক্ষমতাসীন সরকারগুলো সব সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখতে চায় যাতে গণমাধ্যম নিজেই নানা সংকটে পড়ে থাকে, অন্যদিকে নজর দেয়ার সুযোগ না পায়। নির্বতনমূলক আইন, হয়রানি, নিয়ন্ত্রণ এসবই অনুষঙ্গ মাত্র।
সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ সুবিধাবাদী বা অগণতান্ত্রিক শাসক, অবৈধ দখলদার, জুলুমবাজ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি, লোভী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতার লুটেরা, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ, ধরিবাজ মানবতাবাদী, সুদী এনজিও মহাজন, চোরাকারবারি, উগ্র ধর্মীয়-জাতি বা চরমপন্থী গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ডাক্তার, বাহাদুর পুলিশ,ধনপতি আমলা, টেন্ডারবাজ, টেন্ডারবাজের পার্টনার ইঞ্জিনিয়ার, কোচিং সেন্টারের শিক্ষক, দলবাজ সাংবাদিক নেতা- এরাই।
সংবাদমাধ্যমকে বরাবরই শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষ মনে করে আসছে। কারণ শাসকের চরিত্র দিন দিনই বদলে যাচ্ছে। জনগণ আর সেবামুখী চরিত্রের বদলে দখল, পীড়ন, লুটপাট আর টিকে থাকার নেশায় জনমুখীতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যম একই চোখখোলা জনচরিত্রে পাহারাদারিতায় জেগে আছে। একই পথের দুই সারথী হলেও রাষ্ট্র আর গণমাধ্যম তাই এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য সবসময়ই এই দুই সম্পর্কের মধ্যে বোঝাপড়ার লড়াই থাকে। আর তাই সাংবাদিককে গোপনে কোণঠাসা করার দীর্ঘদিনের চেষ্টা থেকে বেরিয়ে এখন প্রকাশ্যেই পেটানো হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক চাপ, প্রতিপক্ষ বা নিজ থেকেই নিয়ন্ত্রণের কারণে গণমাধ্যম এখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে অনেক হারিয়ে ফেলেছে।
পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠীও তাদের অপকর্ম, দুর্নীতি বা অপশাসন উদঘাটন কিংবা অগণতান্ত্রিক বা অমানবিক কর্মকা-ের সমালোচনা শুনবার বা সইবার মানসিকতা রাখে না। নেতিবাচক সবকিছুতেই অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে পরিগণিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যারা অপরাধী ও নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায় তারাই সাংবাদিককে ভয় করে- প্রতিপক্ষ ভাবে। লড়াইটা আসলে ন্যায়-অন্যায়ের। তাই সংকটসহ সব অবস্থায় সাংবাদিককে একমাত্র সত্যের দৃঢ়তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
বস্তুুনিষ্ঠতার বাইরে সংবাদ টিকে থাকতে পারে না। এর বিচ্যুতি বা স্খলন সাংবাদিককে নৈতিকতার শক্তি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। পক্ষপাত শুধু অনৈতিক নয়, অন্যায়ও। তখনই সে আরও অসহায় হয়ে পড়ে। সামাজিক সমর্থন হারিয়ে ফেলে। এমনিও সংকটে ক্ষমতাধরের অপপ্রচার তাকে একা টিকে থাকতে দেয় না। মিথ্যা তখন সাময়িক সত্যের ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। সব ওলট-পালট করে দিতে চায়। অধিকাংশ সময়ই প্রথমে এমন অপপ্রচারই জয়ী হয়ে যায়। পড়ে যখন সত্য ওঠে আসে স্বমহিমায় তখন অনেক কিছুই হারাতে হয় ওই সাংবাদিককে। সাধারণত এমনটাই ঘটে। কারণ ওই সময় লড়াইটা তাকে একাই করতে হয়। কিছু বন্ধু জোটে, তবে বেশ পড়ে। তখন অবশিষ্ট থাকে সান্ত্বনাটুকু। এটাই বাস্তব পরিণতি একজন আক্রান্ত সাংবাদিকের। সাংবাদিক নিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই উদাসীন। পুরোটাই মেধা ভিত্তিক কাজ বলে নিজ পেশায় রেষারেষিই বেশি চলে। সাংবাদিকের ব্যক্তি সংকটে পেশা ভিত্তিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি এখনও। যার সুযোগ নিচ্ছে সুবিধাবাদীরা।
বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস বাড়ছে। সব সংবাদই একক ভাবে আগের মতো হুট করে বিশ্বাস করতে চান না। একটু পরখ করে নেন। যাকে কিছুটা আস্থার সংকট বলা চলে। যদিও এ সম্পর্কগুলোর ওঠা- নামা সবসময়ই বিদ্যমান। পাশাপাশি ক্ষমতাধরদেরও নিজেদের মিডিয়া আছে, আছে ভুঁইফোঁড় অনলাইন। সেখানেও সাংবাদিক কাজ করেন।
সংবাদমাধ্যম প্রতিযোগিতা করে। এমন প্রতিযোগিতা থাকা চাই, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতিপক্ষ হতে পারেন, একপক্ষ আক্রান্ত বা আহত হলে অন্যপক্ষ হাততালি দিতে পারেন? এর ফলে যে এক সময় নিজের/তাদের ওপরও খড়গ নেমে আসার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া হয়, সেটা কি বিবেচনায় রাখা দরকার না। পাশাপাশি সংকটে ব্যক্তি সাংবাদিকের নিরাপত্তায় কি করণীয় তাও সাংবাদিকদেরকেই বের করতে হবে। উদাহরণ তৈরি করতে হবে সব স্তরের সব সাংবাদিকদের জন্যে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।