ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণটিকায় অন্তহীন ভোগান্তি

inside post
এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
নির্ধারিতের কয়েকগুণ লোক সমাগম, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, বিশেষ ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক রেজিস্ট্রেশন, নির্ধারিত সময়ের পরে কার্যক্রম শুরু, মাত্র আধা ঘন্টার ব্যবধানে এক মহিলাকেই দুই ডোজ টিকা প্রদান করা, কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতাসহ নানান কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণটিকা কার্যক্রমে হয়েছে অন্তহীন ভোগান্তি। অনেকটা বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই চলে পরীক্ষামূলক টিকাদান ক্যাম্পেইন। অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে টিকা না নিয়েই ফিরে গেছেন। এতে করে টিকা নিতে আসা নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে চরম ক্ষোভের।
শনিবার (৭ আগস্ট) সকাল ৯ টা থেকে জেলার পৌর এলাকার ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ১১০ টি কেন্দ্র কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতি কেন্দ্রে রেজিস্ট্রেশনভূক্ত বিভিন্ন বয়েসী ২০০ নারী-পুরুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জেলা সদরে টিকাদান কর্মসূচির বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান, পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পঙ্কজ বড়ুয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রহিম বিজনসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
এদিকে জেলার সরাইল উপজেলায় মাত্র আধা ঘন্টার ব্যবধানে এক মহিলাকেই দেওয়া হয়েছে দুই ডোজ করোনার টিকা! উপজেলা সদরের সৈয়দটুলা গ্রামের মো. মুসলিম খানের স্ত্রী রোজিনা বেগম সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পেইন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি জানাজানির পর ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে যান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
রোজিনা বেগমের স্বামী মুসলিম খান জানান, দুপুরে সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন রোজিনা। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর টিকা নেন তিনি। এরপর টিকা কার্ডের জন্য রোজিনা কেন্দ্রেই অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর টিকাদান কর্মী আফরিন সুলতানা এসে রোজিনাকে আবারও টিকা দেন। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর এখনও পর্যন্ত রোজিনার শারীরিক কোনো সমস্যা হয়নি। তবে পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হয় কি না তিনি সেই দুশ্চিন্তায় আছেন। এদিকে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তি ঘটনা তদন্ত করতে যান ওই টিকাদান কেন্দ্রে। এই নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোমান মিয়া বলেন, রোজিনা প্রথমে একবার টিকা নিয়ে চলে যান। কিছুক্ষণ পর আবার কেন্দ্রে এসে বলেন তিনি টিকা কার্ড ফেলে গেছেন। তখন টিকাদানকর্মীর জিজ্ঞাসায় তিনি টিকা নেননি বলায় তাকে টিকা দেন। টিকা নেওয়ার পর ওই নারী চলে গেছেন। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি নিজের উৎসাহ থেকে এ কাজ করেছেন। তবে দুই ডোজ নিলেও ওই নারীর কোনো সমস্যা হবে না।’
জেলার আখাউড়া উপজেলায় টিকা নিতে আসা ২৫ বছর ঊর্ধ্বের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বিড়ম্বনায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলেই নিতে হয়েছে টিকা। উপজেলা সদরের জাহানারা হক মহিলা কলেজ, দেবগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মনিয়ন্ধ ইউনিয়নে মনিয়ন্ধ উচ্চ বিদ্যালয়, ধরখার ইউনিয়নে নূরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও মোগড়া ইউনিয়নের নয়াদিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এই পাঁচটি কেন্দ্রে প্রথম দিনে গণটিকা কার্যক্রম চলেছে।
আখাউড়া উপজেলার দেবগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং মনিয়ন্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে লক্ষ্য করা গেছে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। দীর্ঘ লাইনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি।ধরখার ইউনিয়নের নূরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুর ১২ টায় ৬০০ ডোজ টিকা শেষ হয়ে যায়। টিকা নিতে আসা অনেকেই পড়েছেন বিড়ম্বনায়। প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন ছাড়া ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে টিকা নিতে পারবে, এমন ঘোষণায় রেজিষ্ট্রেশন না করে টিকা নিতে আসা অনেককেই ফিরে যেতে হয়েছে। আবার অনেকে তাৎক্ষণিক ৫০ টাকা করে দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে টিকা নিয়েছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রাশেদুর রহমান জানান, ‘প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্রে সাতজন করে স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ সদস্য, আনসার ও বিভিন্ন সংগঠনের সেচ্ছাসেবীরা সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছেন।’
জেলার বিজয়নগর উপজেলার অনেক কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ে টিকাদান শুরু হয়নি। তন্মধ্যে উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনে সকাল পৌণে ১০টায় শুরু হলেও ছিলো না কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই। স্বেচ্ছাসেবক না থাকায় শুরু করতে পারেননি বলে জানান কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার।
ইউনিয়নের কামালমুড়া গ্রামের গোলাপি বেগম (৬৫) টিকা নিতে এসে দীর্ঘ লাইন দেখে ফিরে যান বাড়িতে। সেজামুড়া গ্রামের শতবর্ষী মোহাম্মদ ফিরুজ মিয়াও বড় লাইন দেখে টিকা না দিয়েই বাড়িতে ফিরে যান। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ‘যাদের পরিচিত লোক আছে, রাজনীতি করে, তাদের লোকদের আগে টিকা দিয়ে দেয় কিন্তু আমাদের কোনো লোক নেই তাই টিকা দিতে দেরি হচ্ছে।’ টিকা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার নোয়াব মিয়া বলেন, ‘তিনটা বুথে ছয়জন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছে কিন্তু আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য রেডক্রিসেন্ট ও স্কাউট সদস্যদের থাকার কথা থাকলেও তাদের পাইনি। পরে নিজেরা লোক ব্যবস্থা করে কাজ চালাচ্ছি।’ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ খন্দকার বলেন, ‘এখানে ৬০০ মানুষ টিকা পাবে। এর বেশি হলে অন্যরা টিকা ছাড়াই চলে যেতে হবে। কারণ এটাই আমাদেরকে নিয়ম করে দিয়েছে। যারা টিকা পাবে না তারা উপজেলা ভবনে গেলেই টিকা পাবে।’
এদিকে জেলার নাসিরনগর উপজেলায় নাসিরনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে গণটিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম এম.পি।এসময় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রাফি উদ্দিন আহম্মদ, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. মেহেদী হাসান খান শাওন, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রুবিনা আক্তার, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায়,থানার ওসি মো. হাবিবুল্লাহ সরকার, প্রেস ক্লাব সভাপতি সুজিত কুমার চক্রবর্তী, কলেজ কর্তৃপক্ষ, দলীয় নেতৃবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ৬০০ করে মোট সাত হাজার ৮০০ জনকে টিকা প্রদান করা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায় জানান, ‘গণটিকা কার্যক্রম ছাড়াও প্রতিদিনই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স টিকা প্রদান কার্যক্রম চালু থাকবে, কেউই বাদ যাবে না।’
এছাড়া জেলার আশুগঞ্জ, নবীনগর, কসবা, বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়ও পৌর এলাকার ওয়ার্ডে এবং ইউনিয়ন এলাকায় বিভিন্ন কেন্দ্র গণটিকা ক্যাম্পেইন হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে বিভিন্ন বয়েসী দুইশ’ জন নারী-পুরুষকে টিকা প্রদান করা হয়। এই কার্যক্রমের আওতায় জেলায় ৬১ হাজার ব্যক্তিকে টিকার আওতায় আনা হয় বলে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ জানান, ‘করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রমকে জোরদার করা হয়েছে। স্থায়ী কেন্দ্রে টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি গণটিকার প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। মহামারি মোকাবেলায় টিকা গ্রহণে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া রয়েছে।’
জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান জানান, ‘টিকা গ্রহণে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ গড়ে ওঠেছে। আমরা চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকলের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে করোনার গণটিকাদান কর্মসূচি সফল করতে কাজ করছি। পর্যায়ক্রমে সকলকে টিকার আওতায় আনা হবে। এই চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।’
আরো পড়ুন