যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক প্রতীক, আজ বারবার এমন এক সংকটে পড়ে যাচ্ছে, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের কাছেও অচিন্তনীয়। “শাটডাউন”—এই শব্দটি এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন প্রশাসনিক সমস্যা নয়; এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকটের প্রতিচ্ছবি।
২০২৫ সালের অক্টোবরের শুরুতে, আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে বিগত কয়েক দশকে বহুবার দেশটিকে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেন এমন হয়? কী হয় এই অবস্থায়? আর এর শেষ কোথায়?
শাটডাউন মানে কী?
“গভর্ণমেন্ট শাটডাউন” বা সরকার বন্ধ হওয়ার অর্থ, সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলতে যে অর্থ প্রয়োজন, তার অনুমোদন না মেলায় ফেডারেল সংস্থাগুলোর কাজ অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রে, প্রতিটি অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর থেকে। তার আগে কংগ্রেসকে একটি বাজেট আইন পাস করতে হয়—যেখানে নির্ধারিত থাকে কোন সংস্থাকে কত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। কংগ্রেসের দুই কক্ষ—হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং সিনেট—এই বাজেট নিয়ে একমত হতে না পারলে, সরকার অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা হারায়।
ফলে:
- “অপরিহার্য নয়” এমন দপ্তর বা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
- লক্ষাধিক কর্মচারী বেতন ছাড়াই ছুটিতে যেতে বাধ্য হন—এটি “ফার্লো” নামে পরিচিত।
- অপরিহার্য খাত (জাতীয় নিরাপত্তা, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) সীমিতভাবে চালু থাকে।
- ২০২৫ সালের শাটডাউন: কেন ঘটলো?
এবারের শাটডাউনের পেছনে মূলত রাজনৈতিক অচলাবস্থা দায়ী।
রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত হাউস ও ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত সিনেট বাজেট নিয়ে একমত হতে পারেনি। তাদের মতপার্থক্য স্পষ্ট কয়েকটি বিষয়ে:
- অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি চায় রিপাবলিকানরা; ডেমোক্র্যাটরা মানবিক সহায়তায় জোর দিচ্ছেন।
- ইউক্রেন ও তাইওয়ানকে সহায়তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
- সামাজিক সেবা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কমাতে চায় হাউস; কিন্তু সিনেট ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই খাতে বরং বরাদ্দ বাড়াতে চান।
কোনো পক্ষই আপস করতে না চাইলে, বাজেট অনুমোদিত হয়নি, এবং শাটডাউন শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, রিপাবলিকান পার্টির মধ্যেও চরমপন্থীদের একটি দল (Freedom Caucus) প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অনেক নীতির ঘোর বিরোধী।
([সূত্র: Britannica, BipartisanPolicy.org, Politico, Washington Post, Wikipedia])
এর প্রভাব কতটা গভীর?
শাটডাউনের প্রভাব কেবল প্রশাসনিক নয়, সম্পূর্ণ অর্থনীতি ও সাধারণ নাগরিকদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
১. অর্থনৈতিক ক্ষতি
প্রতিটি শাটডাউনে মার্কিন অর্থনীতিতে সপ্তাহে বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
- ২০১৯ সালের শাটডাউনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার স্থায়ী ক্ষতি হয়েছিল।
- বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হন, আর ডলারের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. কর্মচারিদের জীবন বিপর্যস্ত
প্রায় ২০ লাখ ফেডারেল কর্মচারীর মধ্যে লক্ষাধিক furlough-এর মুখে।
- জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিতরাও কাজ করছেন বেতন ছাড়া।
- যাঁদের প্রতিদিনের আয়েই সংসার চলে, তাঁদের জন্য এটি এক অভূতপূর্ব আর্থিক দুরবস্থা।
৩. জনগণের সেবায় ব্যাঘাত
- ভিসা, পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন আবেদন বিলম্বিত হচ্ছে।
- জাতীয় পার্ক, যাদুঘর, গবেষণাগার বন্ধ বা সীমিত পরিসরে চলছে।
- বিমানবন্দর নিরাপত্তা, শুল্ক বিভাগ, এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
৪. বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতিবাচক বার্তা
“বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া দেশটি নিজস্ব বাজেটও পাস করতে পারে না”—এই বার্তাটি বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
- উদীয়মান অর্থনীতিগুলো এমন এক যুক্তরাষ্ট্রকে আর আগের মতো নির্ভরযোগ্য মনে করে না।
- এই শাটডাউনের ফলে ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চলমান কিছু কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক আলোচনা থমকে গেছে।
- এই শাটডাউনের শেষ কোথায়?
সোজা উত্তর—কেউ জানে না।
শাটডাউন শেষ করতে হলে কংগ্রেসকে অন্তত একটি Continuing Resolution (CR) পাস করতে হবে—যা একটি অস্থায়ী বাজেট আইন। এতে সরকার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আগের বরাদ্দে কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু এবার সমস্যা আরও জটিল:
- কংগ্রেসে দলীয় বিভাজন এতটাই তীব্র যে আপসের পথ ক্ষীণ।
- রিপাবলিকানদের মধ্যেও একাংশ চরমপন্থী অবস্থানে আছে, যারা বলে—“যতক্ষণ না আমাদের দাবিগুলো মানা হচ্ছে, ততক্ষণ শাটডাউন চলুক।”
তাই এটা শুধু একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, বরং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার এক গভীর ব্যর্থতা।
এই সংকট আমাদের কী শেখায়?
এই শাটডাউন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতেও শিক্ষণীয় বার্তা বহন করে।
- যে রাষ্ট্র প্রযুক্তিতে অগ্রগামী, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ, এবং বিশ্ব নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ—সেই রাষ্ট্রও রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত নয়।
- গণতন্ত্র তখনই কার্যকর, যখন দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থ আগে রাখা হয়।
- আপস ও সহনশীলতা না থাকলে, গণতন্ত্রের চাকা থেমে যেতে বাধ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শাটডাউন আমাদের শেখায়—গণতন্ত্রের টিকে থাকার একমাত্র শর্ত হলো ‘সমঝোতা’।
তথ্যসূত্র:
- Britannica: Government Shutdown Explained
- BipartisanPolicy.org
- Politico.com
- WashingtonPost.com
- Time.com
- Reuters.com
- Wikipedia (2025 US Shutdown)
