যেভাবে গড়ে উঠে নূর আলীর রঙের ভুবন

অফিস রিপোর্টার।।
তখন বয়স ১২বছর। প্রাথমিক শেষে পড়ালেখায় মন নেই। পথে পথে ঘুরে বেড়ান। গোল্লাছুট কিংবা হা-ডু- ডু খেলায় দিন কেটে যায়। পুকুরে সাঁতার কাটেন কিংবা পাখির ছানা ধরতে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ান। একদিন পাশের বাড়িতে পাকা ভবনের কাজ চলছে। সেখানের দেয়ালে রঙ লাগানোর কাজ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। কারিগররা তাকে সহযোগিতা করতে বলেন। তিনি পানি টানাসহ নানা কাজ করে দেন। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরেন তখন তার সারা গায়ে ময়লা। মা খোদেজা বেগম কারণ জানতে চান। তিনি জানান, রঙ মিস্ত্রিদের সাথে সারা দিন ছিলেন। এই কাজ তার ভালো লাগে। তার মা উত্তর শুনে আক্ষেপ করে বলেন- তাহলে তো আমার কপালে এত দুঃখ থাকতো না। সাত ভাই এক বোন। একজন ছোট বেলায় মারা যান। বাবা মো.লিল মিয়া খন্দকার ক্ষুদ্র ধান ও মাছ চাষি। তাই টানাটানির সংসার। ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় এস এ নুর আলী। ১৯৯৩সালের কথা। নুর আলীদের বাড়ি কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার খাড়াতাইয়া বেড়াতে আসেন মামা আনোয়ার হোসেন। এসে দেখেন সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বড় ভাগিনা নুর আলী খবর নেই। খবর নিয়ে জানেন তার পড়া লেখায় মন নেই। আনোয়ার হোসেন ঢাকায় রিকশা বডির কাজ করেন। তাই ভাগিনাকে ঢাকায় কাজ শিখতে নিয়ে যান। আনোয়ার হোসেন ঢাকার জুরাইনে আবদুল মান্নান নামের একজনের নিকট রিকশাচিত্রের কাজ শিখতে তাকে দেন। এখানে আসার কয়েক বছর পর নুর আলী কাজে বৈচিত্র্য খুঁজতে থাকেন। পরিচয় হয় এস এ মালেক নামের আরেকজন শিল্পীর সাথে। এস এ মালেক দেশের বিখ্যাত রিকশাচিত্র শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাকিমের ছেলে। সেখানে গিয়ে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। তিনি কাজের নতুন ধারণা পান। সেখানে এস এ মালেকের ছোট ভাই আবদুর রহিমও তাকে কাজ শেখান। ২০০২ সালে তার বাবা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান। পরিবারে ভার তার কাঁধে। ২০০৪সালে তিনি কুমিল্লায় চলে আসেন। ছয় ভাই একস সাথে কাজ শুরু করেন। ৩ভাই অন্য পেশায় চলে যান। বাকি এস এ নুর আলী, এস এ আউয়াল ও একে সজিব নিয়মিত কাজ করছেন। এস এ নুর আলী রিকশা,সিএনজি অটো রিকশার সাথে ব্যানার সাইনবোর্ড,দেয়ালে কাজ করেন। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সামগ্রীতে আর্ট করা।

inside post

(ছবি:ইলিয়াছ হোসাইন।)
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়,কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক। পদুয়ার বাজার বিশ^রোড পার হয়ে ২০০গজ দক্ষিণে মহাসড়কের পাশে নুর আলী আর্ট সেন্টার। সেখানে চালকরা সিএনজি অটো রিকশা নিয়ে আসছেন চিত্র এঁকে দিতে। কেউ আসছেন রিকশা চিত্র কিনতে। কখনও তিন ভাই সহকারীদের নিয়ে আঁকছেন বিভিন্ন সামগ্রীর উপর। সেগুলো হচ্ছে হারিকেন,চশমা,কেটলি, শোপিস রিকশা,গরুর গাড়ি,সিএনজি অটো রিকশা,মাটি ও এলুমিনিয়ামের হাড়ি পাতিল। তাদের তুলির ছোঁয়ায় এক একটা চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। দেয়ালেও রয়েছে নানা শিল্পকর্ম। রয়েছে সিনেমার চিত্র।
এস এ আউয়াল ও একে সজিব বলেন, আমরা ছয় ভাইয়ের পরিবার একসাথে থাকি। ভাই এস এ নুর আলী থেকে কাজ শিখেছি। আঁকতে আমরা আনন্দ পাই, সাথে রোজগারও হচ্ছে।
এস এ নুর আলী বলেন,ছোট বেলা থেকে আমার রঙের প্রতি নেশা। গ্রামে ছোটবেলায় রিকশা দেখলে তার উপর আঁকা চিত্রে হাত বুলিয়ে দেখতাম। প্রশ্ন জাগতো- কিভাবে এটা আঁকলো? এখন রিকশা কমে যাচ্ছে। তাই আমরা বিকল্প হিসেবে শো-পিসে কাজ করছি। এগুলোর বিদেশে চাহিদা রয়েছে। সরকার সহযোগিতা করলে আমরা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবো। তিনি আরো বলেন,অন্য ওস্তাদদের সাথে আমি এস এ মালেক স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন। আমি ভাইদের সাথে অন্যদের শেখানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া কুমিল্লা অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিত্রশিল্পীদের একত্রিতের চেষ্টা করছি। যাতে এই শিল্পটি হারিয়ে না যায়। কোন শিল্পী যেন আয়ের সমস্যায় না পড়েন।
এস এ মালেক বলেন,১২/১৩বছর নুর আলী আমার নিকট ছিলো। তার কাজ শেখার প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তার ভিতরে আমি সততা ও বিনয় বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। তখন তার প্রতি একটু বেশি দরদ দেই। তখনই মনে হয়েছে সে অনেক দূর যাবে। তাকে ছোট ভাই ও পারিবারিক সদস্যের মতো দেখি।
জেলা কালচারাল অফিসার আয়াজ মাবুদ বলেন,রিকশাচিত্রকে ইউনেস্কো বিশ^ ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রান্তিক রিকশাচিত্র শিল্পীদের খুঁজে এনে তাদের কাজ বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে। নুর আলী ও তার ভাইদের কাজ সম্পর্কে আমাদের ধারণা রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা আরো ভালো করবে।
বিসিক কুমিল্লার ডিজিএম মো. মুনতাসীর মামুন বলেন,শো-পিস নিয়ে কাজ করার বিষয়টি ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় পড়ে। তাদের কাজের পরিধি বৃদ্ধিতে কোন ঋণের প্রয়োজন হলে আমরা সহযোগিতা করবো।

আরো পড়ুন