শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে ঘাসের পাপোষে…

খাজিনা খাজি ।।
বরাবরের মতোই নিমগ্ন স্বভাব ছিলো আমার। প্রকৃতি , ফুল, পাখি এইসবের সংমিশ্রণ আমাকে সব সময়ের জন্যই আন্দোলিত ও আলোড়িত করেছে। নিজস্ব রুচি বোধের বাইরে খুবই কম হেঁটেছি। আক্রান্ত হলে প্রত্যাঘাতকে না বলে এড়িয়ে গিয়েছি সম্মুখ পথে। সমকালের বহু ঘটনা দেখেও স্বভাবগত কারণে এইসব নিয়ে তর্ককে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। অপছন্দের ঘটনা ও অপ্রত্যাশিত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করতে হচ্ছে অনায়াসে। শৈশব কেটেছে মাটি , লতাপাতা দিয়ে খেলা করতে করতে। কৈশোর কেটেছে গ্রামের পরিবেশে চরম দুরন্তপনায়। বৈশাখ মাসের কালবৈশাখী ঝড়কে উপেক্ষা করেই আম কুড়িয়ে নেয়া, পুকুরে সাঁতার, দৌড়ঝাঁপ এই সবের মধ্য দিয়ে। চৈত্রের শেষের দিকে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ঘাসের পাপোষে ওপর বসে বসে লিখেছি বলেছি কত কথা!
সেই মনের মানুষ প্রাণের খোরাক যার সাথে ছিলো বন্ধুত্ব আত্মার ,নাম তার ইসরাত জাহান খুকি। খুকি আর আমি লিখতাম কাগজে কাগজে। দুইজনেই পড়তাম সেই লেখা আবার ছিড়েও ফেলে দিতাম। পৃথিবীর অজান্তেই আমাদের লেখায় ফুটে উঠত সবকিছু ভাঙ্গা , গড়া , পতন, প্রেম , বিরহকাতরতা। বৃত্তের মধ্যেই ঘুুরে ঘুরে যেন জানলার ফাঁক দিয়ে বিশ্বকে দেখা। এইসবে দু’ জনের চোখেই খেলতো অপার আনন্দ। এই আনন্দের কথা মনে আসলেই মনে পড়ে এটাই তো কবিতা।
কাব্যচেতনা মূলত আশা – আশাহীনতা, স্বপ্ন – স্বপ্নহীনতা , বিদ্রোহ – আপসময়তা, জীবনযাপনের আনন্দ ও গ্লানি, মুক্তি আর অধীনতার নিগড়ে সতত বিক্ষত। নানামুখী ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠলেও নিজের ভেতরে পুষে রেখেছি সব প্রকাশ ঘটানো হয়নি তেমনকিছু। পরিস্থিতি আমাকে কখনও অশান্ত করতে পারেনি। ছোট বেলা থেকেই নীরব পড়ুয়া ছিলাম। পাশাপাশি টুকটাক কবিতা , ছোট গল্প, ভ্রমণ কাহিনী লেখাও চলমান ছিলো সহজ সরল ভাষায়। পড়াশোনার চক্রে এইচ এস সি শেষ করেই সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তি হই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। পড়াশোনার সাথে সাথে কলেজের নানা সংগঠনের সাথে ও জড়িত হয়ে যাই। যেমন – বিএনসিসি , রেড ক্রিসেন্ট ও ক্যাম্পাস বার্তা ইত্যাদি। একবার বিএনসিসির ম্যাগাজিনের জন্য লেখা আহ্বান করা হয়। বাছাই পর্বে আমার একটি কবিতা ও একটি ভ্রমণ কাহিনী নির্বাচিত হয়। যা ভেতরে অনুরণন জাগায়। কিন্তু কখনও কল্পনাও করিনি শখের বশে লিখেতে লিখতে আমি লিখতে শিখব অল্প অল্প করে। বিএনসিসির সাবেক সিইউও নয়ন দেওয়ানজি স্যার যিনি আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন – খাজিনা তোমার লেখালেখির হাত ভালো এটা তুমি ছেড়ো না। সেই ছোট্ট একটা লাইন আজও আমাকে প্রেরণা জাগায়। আমার লেখার স্বীকৃতি হিসেবে স্যার আমাকে পুরষ্কৃত করলেন। বিশাল একটা ফটো ফ্রেম যেখানে ছিলো আমার,সাহিদার আর রাশিদা আপুর যৌথ একটা ছবি। যা লেখালেখির প্রথম পুরষ্কার।
তারপর ভিক্টোরিয়া কলেজের ক্যাম্পাস বার্তা পত্রিকা একটা সিঁড়ির মতো আমাকে ধাপে ধাপে লিখতে ,লেখা চালিয়ে যেতে বেশ সহায়তা করেছে। ক্যাম্পাস বার্তার সাবেক সম্পাদক মহসিন কবির ভাই তার সম্পাদনাকালে প্রতি সংখ্যাতে আমার লেখা নিয়ে ছাপাতেন। সামান্য ভুলত্রুটি থাকলে কাঁটছাঁট করে ছাপাতেন আর বলতেন তুমি এই ছন্দে লিখেছো। কুমিল্লার আঞ্চলিক পত্রিকা গুলোতে প্রায়ই কবিতা ছাপানো হতো এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিলো আজিম উল্লাহ হানিফের। সে কবিতা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় দিত। সংগঠনের ম্যাগাজিনগুলোতে নিয়মিত আমার কবিতা ভ্রমণ কাহিনী ও ছোট গল্প ছাপা হতো। কিন্তু আমি তখনও বুঝে উঠতে পারি নি আমি যে চাইলেই লিখতে পারি। তা জানতে বা বুঝতে পারলে হয়তো আরও আগেই সাহিত্য চর্চায় সক্রিয় হওয়া যেত।
প্রাণিবিদ্যায় পড়াশোনা ও ব্যবহারিকের চাপও কম ছিলো না। তবুও যখনই ক্ষুধার মতো কবিতা লেখার ক্ষুধা হতো লিখতাম। লিখে লিখে টাইম লাইন ভর্তি করে রেখে দিতাম অনলি মি করে। ২০১৮ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে পুুরোপুরিই লেখা বন্ধ হয়ে যায়। তখন চাকুরির পরীক্ষার জন্য সুফিয়া কামাল লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়াশোনা করা হতো। নয়ন স্যার মাঝে মধ্যেই লেখা চাইতেন তখন সময় পেতাম না বলে লেখাও পাঠাতে পারতাম না। ২০২০ সালে যখন করোনা মহামারি চলে তখনই আবারও লেখা চাইলেন তাও করোনা সংক্রান্ত। স্বদেশ জার্নালে “করোনা প্রকৃতির প্রতিশোধ” কবিতাটি ছাপা হয়। আমি তেমন আর লিখছি না। হঠাৎই একদিন আমার বন্ধু মজিব যে, কুমিল্লা কবি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশবাংলার প্রকাশক তার সাথে যোগাযোগ হয়ে যায়। কথায় কথায় প্রাণে জাগে স্মৃতি কথা। আমি বলে উঠি তোর দেয়া কবিতার লিফলেটটা এখন আমার কাছে আছে। এইভাবেই কথার ছলে কবিতা নিয়ে হয় কথা বেশ কিছুটা। আমি বলে বসি আমিও কবিতা লিখি শখ কওে, প্রকাশ করি না। সে এবার নাছোড়বান্দা আমার কবিতা পড়বে। আমিও দিলাম পাি য়ে কপি পেস্ট কয়েকটা। বেশ কবিতা পড়া শেষ। এবার তার বায়না আমি যেন কবিতা লেখা না থামিয়ে দেই। সেই কথা তাকে দিতেই হবে। আমি ইত:স্ততবোধ করলাম এক রকম বাধ্য হয়ে বললাম,ঠিক আছে লিখব। বন্ধুকে কথা দিয়ে তো মহা বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। শুরু করলাম আবারও লেখা, যা এখনো চলমান। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “দাহকালের কাব্য”। যা পাঠকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। পাঠকদের অনুপ্রেরণাই বর্তমানে আমার জন্য বড় অনুপ্রেরণা। আমি লিখতে থাকবো সেই অনুপ্রেরণা নিয়েই।
লেখক; কবি ও সংগঠক।
