সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে

মনোয়ার হোসেন রতন।।
এই একটি বাক্য যেন আজকের বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রের সবচেয়ে দগদগে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল একটি সাহিত্যের উক্তি নয়, বরং সময়ের এক ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী—যা এখন বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে পরিবার পর্যন্ত, সর্বত্র চলছে এক নৈতিক দেউলিয়াপনার মহামারী। সত্য, সৌন্দর্য, মূল্যবোধ, মেধা—সব আজ পরাজিত। জয়জয়কার কেবল নষ্টদের।
পরিবার: আদর্শ হারানো এক প্রতিষ্ঠান
এক সময় পরিবার ছিল চারিত্রিক গঠনের প্রথম পাঠশালা। যেখানে বাবার মুখে থাকত সততার গল্প, মায়ের আদলে ফুটে উঠত সহানুভূতির ছায়া। সন্তান বড় হতো আত্মমর্যাদা, বিবেক আর সংযমের পাঠে।
আজ পরিবার এক সুবিধাবাদী চুক্তি মাত্র। বাবা-মা সন্তানের মধ্যে বিনিয়োগ খোঁজে, ভালোবাসা নয়। সন্তানের স্কুল, পোশাক, গ্যাজেট—সবই যেন ‘সোশ্যাল স্ট্যাটাস’ বাড়ানোর অস্ত্র। অথচ এক কাপ চা হাতে নিয়ে সন্তানের সঙ্গে জীবনের গল্প ভাগাভাগি করা হয়ে ওঠে অবাঞ্ছিত বিলাসিতা।
মেধাবী আর নীতিবান সন্তানের জন্য এ সমাজে এখন কোনো জায়গা নেই—চাকরি পায় সেই, যার পিছনে থাকে ক্ষমতাধর আত্মীয় কিংবা ঘুষের ব্যবস্থাপত্র। আর পরিবার চুপচাপ এই অন্যায়কে মেনে নেয়—কারণ সাফল্য এখন আর সততায় মাপা হয় না, মাপা হয় চতুরতায়।
সমাজ: হিপোক্রেসির অভয়ারণ্য
আজকের সমাজে ভালো মানুষ হওয়া একটি ব্যর্থ প্রকল্প। কারণ এখানে দুর্নীতিবাজেরা সম্মানিত, প্রতারকেরা প্রভাবশালী, আর ভদ্র মানুষেরা কোণঠাসা।
চোখের সামনে অন্যায় দেখে যারা চুপ থাকে, তারাও এ নষ্ট সিস্টেমের মৌন সমর্থক। শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক—সব পেশাই আজ নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। শিক্ষক টাকার জন্য কোচিং করান, সাংবাদিক পেইড নিউজে সত্য বিকিয়ে দেন, শিল্পী রুচিহীন ভাইরালের দাসত্ব মেনে নেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ভালোবাসা নয়—ভাইরাল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা নয়—‘কে কার লোক’ সেটাই মুখ্য। আর তাই সমাজে নৈতিকতা নয়, চালাকি ও চক্রান্তই এখন সবচেয়ে বড় যোগ্যতা।
রাষ্ট্র: গণতন্ত্রের পোশাকে গদির চোরাগলি
রাষ্ট্র নামের এই যন্ত্রটি এখন জনগণের জন্য নয়, একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস, প্রশাসনের দলীয়করণ, বিচার বিভাগের পক্ষপাত—সবকিছুই প্রমাণ করে রাষ্ট্র এখন একটি রাজনৈতিক কর্পোরেট কোম্পানি। আমরা দেখেছি, সাহসী মত প্রকাশ করলে গুম, খুন বা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা—এ হলো গণতন্ত্রের বাস্তব রূপ।
বিরোধী মত মানেই রাষ্ট্রের শত্রু, সমালোচক মানেই ষড়যন্ত্রকারী—এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা মৃতপ্রায়। এ রাষ্ট্র এখন নষ্টদের কাছে জিম্মি।
তাহলে কি আমরা শেষ?
না। এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান, অন্যায়ের প্রতিবাদে চাকরি হারান, সত্য উচ্চারণে কারাবরণ করেন, জীবনবাজি রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাদের কারণেই এই জাতি এখনো কিছুটা শ্বাস নিতে পারছে।
তবে সংখ্যায় তারা নগণ্য। যদি এ কণ্ঠ গুলোও একে একে নিভে যায়, তাহলে সত্যি সত্যিই হুমায়ুন আজাদের সেই বাক্য হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অনিবার্য নিয়তি:
“সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।”
তখন আর সাহিত্য বা বেদনার ভাষা লাগবে না, আমাদের সন্তানরা ইতিহাসের বই খুলে জানবে—এ দেশ একদিন নষ্টদের হাতেই বিকিয়ে গিয়েছিল।
inside post
আরো পড়ুন