সাক্ষরতা দিবস: বাংলাদেশ ও বৈশি^ক বাস্তবতা

মুহাম্মদ আবু হানিফ সিরাজী

inside post

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস মূলত জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখকে “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে জাতিসংঘ এই দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে । দিবসটির লক্ষ্য- ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা। বর্তমানে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এ দিবসটি উদ্যাপন করে থাকে। ২০২২ সালেও বিশে^র বিভিন্ন স্থানের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দিবসটি উদযাপন করা হবে। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি-৪) মানসম্মত ও সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রসারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮বিলিয়ন। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, বিশে^ ৭১১ মিলিয়ন মানুষ নিরক্ষর। তন্মোধ্যে অধিকাংশ নারী, যারা লিখতে ও পড়তে পারে না । ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে সাক্ষরতা দিবস উদযাপন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ঠাকুরগাঁওয়ে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের অনুষ্ঠানটি ঠাকুরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, এ দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রামকে প্রথম নিরক্ষরতা মুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিগত কিছু সময় কেটেছে কোভিডের মতো মহামারীতে। এই বৈশি^ক মহামারীর পর পৃথিবী আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনায় মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবি (সা.) পৃথিবীতে আগমন করেছেন মানুষের জন্য শিক্ষক রূপে। পৃথিবীব্যাপী মানুষ প্রতিনিয়ত শিখছে। আধুনিক শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ- সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তি পালন করেছে। স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠি বেশ প্রয়োজন। আর তা ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদেও শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ।
দেশে এ মুহূর্তে সাক্ষরতার গড় হার প্রায় ৭৫। বিভাগভেদে এ হার কমবেশি আছে। সবচেয়ে পিছিয়ে আছে চারটি জেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ বিভাগ। এ বিভাগে সাক্ষরতার হার প্রায় ৬৭, যা দেশের গড় হারের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ কম।
সাক্ষরতার হারের এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে। জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাক্ষরতার হারে সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিভাগ, হার প্রায় ৭৯। এর পরে রয়েছে বরিশাল, ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সাক্ষরতার হার চট্টগ্রামে ৭৬ দশমিক ৫৩, খুলনায় প্রায় ৭৫, সিলেট ৭১ দশমিক ৯২, রাজশাহী ৭১ দশমিক ৯১, রংপুর ৭০ দশমিক ৭৫ ও ময়মনসিংহে ৬৭ শতাংশ। ২০১১ সালে করা জনশুমারির বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে সর্বোচ্চ সাক্ষরতার হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭৬। আর সর্বনিম্ন ছিল সিলেটে, ৪৫ শতাংশ। তবে এবার শীর্ষে উঠে এসেছে ঢাকা বিভাগ। আগেরবার ঢাকা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। তবে তখন ময়মনসিংহ বিভাগ ঢাকা বিভাগের মধ্যে ছিল। এবার ময়মনসিংহ বিভাগের হিসাব আলাদাভাবে এসেছে। আগেরবারের তৃতীয় স্থানে থাকা খুলনা এবার চতুর্থ স্থান পেয়েছে।
ড়িৎষফঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হৎবারব.িপড়স এর তথ্যমতে, বিশে^ সাক্ষরতার শীর্ষ দেশ ক্রমান্বয়- উজবেকিস্তান, ইউক্রেন, সান ম্যারিনো, লাটভিয়া, এস্তোনিয়ো। বর্তমান পৃথিবীতে শতভাগ সাক্ষরতা সম্পন্ন দেশটি উজবেকিস্তান। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২০বছর পর স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থাৎ ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করা উজবেকিস্তানের সাক্ষরতার হার শতভাগ হওয়ার অনুঘটক সমূহ থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়া উচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া পৃথিবীর আরেকটি দেশ কাতারের সাক্ষরতার হারও শতকরা ৯৩.৪৬। পারমানবিক অস্ত্রের অনন্য অংশীদার উত্তর কোরিয়াও শতভাগ সাক্ষরতার হার নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেশ। কিম জং উং এর কড়া নির্দেশনার কথা পৃথিবীর সবারই কম-বেশি জানা। কড়া অনুশাসনই যদি সাক্ষরতার হার শতভাগের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশেই শুরু হোক এমন শাসন। বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেটের প্রতুলতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়ে থাকে। তাছাড়া সাক্ষরতা অভিযানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের অংশীদারিত্ব সমভাবে প্রয়োজন।
পৃথিবীর মানুষকে নিরক্ষরতা মুক্ত করা সময়ের দাবি। এজন্য প্রয়োজন মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তাছাড়া বিশ^ব্যাপী সুশিক্ষার অভাবে জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন আশা করাটাও বেশ দুষ্কর।
লেখক: প্রভাষক, দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা।

 

আরো পড়ুন