করোনাকালীন বেকারদের প্রতি মানবিক হোন–ওসমান গনি
আরো পড়ুন:
সারা বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে গতানুগতিক ভাবে এগিয়ে চলছিল বাংলাদেশ। সারাবিশ্বের সাথে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নামও লিখিয়েছিল বাংলাদেশ। হাজার হাজার লোক বেকার থাকা অবস্থায় ও সামনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার কারনে থমকে গেল সামনে চলার পথ। বাড়তে শুরু করল বেকার লোকের সংখ্যা।
মহামারি করোনায় আজ শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্ব কে এলোমেলো করে দিলো। ভেঙ্গে গেছে বিশ্বের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দেশে দেশে বেড়ে চলছে বেকার লোকের সংখ্যা। এ ভয়াবহ করোনার ভয়াবহতা কবে নাগাদ শেষ হবে সেটা আল্লাহ ই ভালো জানেন। দেশী বিদেশী বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার লোকজন একেক সময় একেক কথা বলছে। বাস্তবে তাদের কথার কোন সত্যতা ই খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। একেক গবেষক দল একেক সময় বলছে অমুক মাসে করোনার বিস্তার শেষ হয়ে যাবে আবার কোন কোন গবেষক দল বলছে করোনার সবেমাত্র আরম্ভ হলো। সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে।
এই করোনার অজুহাতে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে অগনিত হারে বেড়ে গেছে বেকার লোকের সংখ্যা। বিশেষ করে পৃথিবীতে অনুন্নত দেশেগুলোর অবস্থা আজ একবারে শোচনীয় অবস্থায় পড়ছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার উল্লেখযোগ্য একটি দেশ হলো বাংলাদেশ। যে দেশে করোনার আগ থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার লোক ছিল। তার সাথে এখন মহামারি করোনার কারনে অনেক লোক চাকরি হারিয়ে, ব্যবসাবাণিজ্য হারিয়ে, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি না হওয়াতে লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের ধন্যাঢ্য দেশেগুলোর ও প্রায় একই অবস্থা।
বিশ্বের ধণী দেশ হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আজ করোনাভাইরাসের কারনে হুহু করে বেড়ে চলছে বেকার লোকের পরিমান। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু এপ্রিল মাসে ২ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে দেশটিতে। ১৯৩০ সালে বিশ্ব মহামন্দার পর এতটা খারাপ সময় পার করেনি দেশটি। সবমিলিয়ে দেশটিতে বেকার ভাতার আবেদন জানিয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মাত্র এক মাস আগেও দেশটির বেকারত্বের হার ছিল মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ; যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও। কঠিন সময়ে মানুষের চাকরি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ হিসেবে বিশ্বের পাঁচ জন কর্মজীবীর চার জনই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। লকডাউন ও মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব দেশে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। তবে বিভিন্ন দেশের সরকার চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
করোনার মহামারির বিস্তার ঠেকাতে সারাবিশ্বের দেশে দেশে চলছে লকডাউন। অনেকেই লকডাউন শিথিল করেছে। কিন্তু পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে মানুষকে ঘরে থাকতে বলায় থমকে গেছে যানবাহন ও কলকারখানার চাকা। স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতিও। এ অবস্থায় দেশে দেশে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন কোটি কোটি মানুষ। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, বিশ্বের বড়ো প্রায় সব অর্থনীতির এবারে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হবে। চীন ও ভারত বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থনীতির গতি রেকর্ড কমে যাবে। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলেছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরইমধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বেকাররা দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে। এসব বলা হলেও বাস্তবে করোনা ভাইরাস অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেটি অননুমেয়। কারণ ইতিমধ্যে বিশ্বের বড়ো অর্থনীতির দেশগুলো অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু মন্দার কবল থেকে পরিত্রাণ মিলছে না তাদেরও।
অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশেও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আরো বেড়ে গেল। করোনা পরিস্থিতি এখন দেশের সব খাতেই প্রভাব ফেলছে। তবে অনানুষ্ঠানিক খাতে এর প্রভাব বেশি, এরই মধ্যে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। করোনার বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবকিছু বন্ধ করে দিলেও মানুষের জীবিকার কথা ভেবে শিথিলতার পথ বেছে নিতে হয়েছে মানুষ নিজ থেকেই। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিতে পারছে না তাদের কার্যক্রম। চলছে সীমিত আকারে। চাহিদা কমে যাওয়ায় সেবামুখী ও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে। যা বেকারত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এদেশের কর্মক্ষম ৬ কোটির ওপরে থাকা মানুষের মাঝে ৫ কোটির বেশি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের অন্তর্ভুক্ত। যাদের আয় নির্দিষ্ট নয়। এদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখের মতো পারিবারিক কর্মসংস্থানে জড়িত, যারা কোনো মজুরির অন্তর্ভুক্ত নয়। করোনায় সব থেকে বড় ক্ষতি হচ্ছে দেশের এই সব অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে যুক্ত ব্যক্তিদের। রেস্টুরেন্ট, রিকশাচালক, পরিবহনকর্মীসহ অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১০ সালে বেকার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ, ২০১২ সালে ২৪ লাখ, ২০১৬ সালের দিকে ২৬ লাখ। বৃদ্ধির এই ধারার তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ২০২০ সালে বেকার সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি।
দেশের ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ মানুষ রয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। লকডাউনের ফলে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ না করলে কোনো উপার্জন থাকে না বলে জীবনযাত্রার মানও তাদের উন্নত নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) হিসেবে ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এক গবেষণায় বলেছে, যদি পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আয় ২৫ ভাগ কমে গেলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখা আরো ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর ভাষ্যমতেও প্রায় ৩০ লাখের বেশি বেকার আছে এখন বাংলাদেশে। দেশের এমন বেকার সমস্যা নিয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। যদিও এই সমস্যা রাতারাতি দূর করা সম্ভব না। সরকার বেকারত্ব নিয়ে কাজ করে যাওয়ার কথা বলছে। তবে সমস্যাটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে করোনা।
যে কোনো দুর্যোগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপরই সবার আগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। করোনা ভাইরাসের আঘাতও এই শ্রেণির শ্রমিকদের ওপরই প্রথমে পড়েছে। অথচ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের রয়েছে বড়ো ভূমিকা। আর দুর্যোগ কেটে গেলেও যে কাজে ফিরবেন, সে নিশ্চয়তা নেই তাদের। এজন্য কাজ হারানো এই মানুষগুলো রয়েছেন বেশি ঝুঁকিতে। করোনা দেশে বাড়তে থাকা এই বেকার সমস্যাকে বাড়িয়ে একদম ঘাড়ের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। এখন থেকেই এই সমস্যা নিয়ে আলোকপাত না করলে করোনা পরবর্তী সময়ে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই সরকারের উচিত দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে সমস্যার লাগাম টেনে ধরা। কোনো দেশের পক্ষেই বেকার সমস্যা একদম নিরসন করা সম্ভব নয়, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে বেকারদের নিজের কর্মসংস্থান নিজের করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার কে আর্থিক সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বেকার লোকদের মধ্যে এমনও লোক রয়েছে যাদের প্রচন্ড মেধা ও বুদ্ধি রয়েছে। অর্থাভাবে তা কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না। এমন বেকার লোকদের খুঁজে খুঁজে বের করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য সহযোগীতা করতে হবে।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Email- ganipress@yahoo.com