‘স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে কুমিল্লার স্মরণীয় বরণীয়’

।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।

প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট

সিনিয়ার রিপোর্টার মোতাহার হোসেন মাহবুবের সর্বশেষ বই “স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে কুমিল্লার স্মরণীয় বরণীয়” নি:সন্দেহে একটি পরিশ্রমসাধ্য প্রবন্ধ সংকলন। সম্প্রতি কুমিল্লার সাহিত্য ও বৃহত্তর পরিসরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা অভিনব প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে এই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ঐতিহ্যবাহী জনপদ, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার স্মরণীয়, বরণীয়, পূজনীয় এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত ও সংক্ষিপ্ত কর্মকান্ড নিয়ে বই প্রকাশ করবার হিড়িক। তা সে গ্রন্থ বা পুস্তক প্রকাশনার ন্যূনতম মান রক্ষা করে বের হচ্ছে কীনা মানা হচ্ছেনা আদৌ।

অতি সম্প্রতি জনপ্রিয় নাট্যজন কুমিল্লার অতি পরিচিত মুখ ও সাংস্কৃতিক কর্মী শাহজাহান চৌধুরী “সুহৃদ স্বজন স্মৃতি” নামে একটি মোটামুটি ৩০২ পৃষ্ঠার মোটা বই লিখেছেন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এমন ৬০ জন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। অতি সম্প্রতি কুমিল্লা নজরুল পরিষদ মিলনায়তনে বইটির আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরপূর্ণ প্রকাশনা উৎসবও সম্পন্ন হয়েছে।

নিকট অতীতে কুমিল্লার বরেণ্য, বিশিষ্ট ও জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বই লেখা হয়েছে কীনা আমার জানা নেই। তবে এ বছর (২০২৪ খ্রি:) মার্চে প্রকাশিত “স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে কুমিল্লার স্মরণীয় বরণীয়” নামে সিনিয়র সাংবাদিক, সুলেখক ও সুপরিচিত সাংস্কৃতিক কর্মী মোতাহার হোসেন মাহবুব একখানা ১৬৪ পৃষ্ঠার বই লিখেছেন। যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা উৎসব গত পহেলা জুন বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও গণপাঠাগারের সম্মেলন কক্ষ বা মুক্তিযোদ্ধা কর্ণারে আয়োজন করা হয়েছিলো। ক্ষুদ্রাকারে হলেও বিদগ্ধজন এ মহতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সময়োপযোগী বক্তব্যও দিয়েছেন।

স্থানীয় বিনয় সাহিত্য সংসদের ব্যানারে আয়োজিত এই বই প্রকাশনা উৎসবটিতে সংগঠনের সভাপতি ও কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ সভাপতিত্ব করেন। কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিজামূল করিম প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন। বইটির ওপর রি-ভিউ বা পর্যালোচনামূলক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা। অন্যান্যের মধ্যে বইটির পর্যালোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরী, কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান, বইটির স্মৃতিচারণে অন্তর্ভুক্ত প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডা সুলতান আহমেদ-এর ছোট ছেলে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এমএস সিকান্দার, কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইদ মাহবুব পাভেল, কার্যনির্বাহী সদস্য মাহবুব আলম বাবু, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট এবং বইটির লেখক।
বক্তারা এই ধরনের আরো বই বা এ গ্রন্থটির পরবর্তী পরিমার্জিত সংস্করণে কুমিল্লার আরো কিছ’ বরেণ্য গণমুখী কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিত্বদের স্মরণ করবার ও তাদের কথামালা উল্লেখ করবার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বইটি বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের কাছে সহজলভ্য ও বিপুল প্রচারের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠাগার কর্তৃপক্ষের সহায়তা ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তারা।

যে প্রসঙ্গে কথা শুরু করেছিলাম সে বিষয়ে আসছি। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ থেকে, সঠিকভাবে বললে ১৯৯২ সাল থেকে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করলেও মোতাহার হোসেন মাহবুব আশি সালেই বিনয় সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে তার এক ডজনের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে বই প্রকাশিত হয়েছ্ ে। তাছাড়া রয়েছে সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন সংকলন প্রকাশ। সময়ে সময়ে। তিনি মাসিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন “আপন”-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক। সংকলনটি বা ম্যাগাজিনটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে থাকে।

সাংবাদিক-লেখক মোতাহার হোসেন মাহবুব খুব সহজ, সরল, বোধগম্য এবং বাগাড়ম্বর-বর্জিত ভাষায় বিভিন্ন সময়কালে সুপ্রতিষ্ঠিত ২৯ জন বরেণ্য ব্যক্তিতে¦র সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত ও তাঁদের গণমুখী জনহিতকর কর্মকান্ড উল্লেখ করেছেন তার ১৬৪ পৃষ্ঠার সর্বশেষ গ্রন্থে । ২০০৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ১৭ বছর ধরে কুমিল্লার প্রথম দৈনিক রূপসী বাংলা এবং স্থানীয় দৈনিক শিরোনাম ও দৈনিক কুমিল্লার কাগজ আর ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক আমোদ-এ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন হচ্ছে বর্তমান গ্রন্থটি। কুমিল্লার উজ্জ্বল দিনগুলোর তেরজন বিশিষ্ট রাজনীতিক, ভাষাবীর ও স্বাধীনতার সংগঠক, আটজন সাংবাদিক ও আটজন চিকিৎসকের বর্ণাঢ্য কর্মবহুল এবং গণমুখী কর্মকান্ড বিধৃত হয়েছে বইটিতে।
বইটিতে যেমন রয়েছেন রাজনীতির গুরু আবদুল রসুল, ভাষাবীর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রথিতযশা রাজনীতিক কামিনী কুমার দত্ত, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট আহমেদ আলী, হাবিব উল্লাহ চৌধুরী, ভাষাসংগ্রামী সিরাজুল ইসলাম, বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আমীর হোসেন, সৈয়দ রেজাউর রহমান, মমতাজ বেগম, তেমনি রয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রজতনাথ নন্দী, গোলাম মোস্তাফা চৌধুরী, কাজী মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল ওহাব, মো ফজলে রাব্বী ও শামসুন্ন্হার রাব্বী।
তাছাড়া, নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক সুরেশচন্দ্র বসু, এসএস সোহানী, সুলতান আহমেদ, দীনেশ রাউত, এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কিরণ চৌধুরী, যোবায়দা হান্নান ও প্রমোদ পাল সম্বন্ধেও বইটিতে উল্লেখ রয়েছে। রয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ¯েœহধন্য, লেখক ও নাট্যাভিনেতা সুলতান মাহমুদ মজুমদারও।

লেখক মোতাহের মাহবুবকে বইটি লিখবার জন্য যথেষ্ট লেগওয়ার্ক বা কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। যেখানে আজকালকার কুমিল্লা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ধরনের ইতিহাসবেত্তা, লেখক, কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা সাধারণত ডেস্কে বসেই কোন স্থান-কাল-পাত্রের ইতিহাস রচনা করে থাকেন। ঘটনা¯থল পরিদর্শন বা খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের বা তাঁদের উত্তরসূরী কারো সঙ্গেই কথা বলাও প্রয়োজন মনে করেননা তাদের তথাকথিত সাহিত্য ও গবেষণাকর্মের স্বার্থে বা প্রয়োজনে। সেখানে স্বভাবগতভাবেই কর্মঠ পরিশ্রমী মোতাহের মাহবুব পরিশ্রম করেছেন বইটি লিখবার কালে। মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ী বানাবার অপচেষ্টা করেননি। স্মরনীয় বরণীয় ব্যক্তিত্বদের উত্তরসূরীদের সঙ্গে কথা বলে, সাক্ষৎকার নিয়ে রেকর্ড করে তবেই বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন, যা কোনভাবেই আয়াসসাধ্য কাজ নয়।

কিছু কিছু মুদ্রণপ্রমাদ ব্যতিরেকে বইটির ছাপা ভালো হয়েছে। মুখবন্ধ লিখে লেখককে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন বাংলা একাডেমীর গবেষণা ফেলো কুমিল্লার কৃতিসন্তান মামুন সিদ্দিকী। তবে, আমার মনে হয়েছে এই আক্রার বাজারেও বইটির দাম সাড়ে তিনশ’ রাখা সমীচীন হয়নি। বিপুল প্রচার ও প্রসারের খাতিরে বইটির দাম আরো একটু কম করা যেতো। প্রচ্ছদ আরো স্পষ্ট ও দৃষ্টিগ্রাহ্য করবার অবকাশ ছিলো। কিন্তু রঙ-এর অযথা কনট্রাষ্ট প্রচ্ছদে শিল্পী কি বক্তব্য তুলে ধরতে চান তা পরিষ্কার হলোনা।

সবশেষে পরবর্তী সংস্করণে কয়েকজন স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম রাখবার জন্য সুস্পষ্টভাবে প্রস্তাব করছি । তাঁদের অন্তর্ভুক্তির জন্য। আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত হলো, সম্ভব হলে পরবর্তী সংস্করণে রাজবিরোধী আশ্রাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, অতিন্দ্রমোহন রায়, ডা আবদুল মান্নান, ডা সত্যেন মজুমদার, ডা মধুসুদন চক্রবর্তী, সাংবাদিক বশরতউল্লাহ, আফতাবুর রহমান, আতিকুর রহমান, রাজনীতিক অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার, অধ্যক্ষ আবদুর রৌফ, আফজাল খান, এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, ফয়েজুল্লাহ, হেদায়েতউল্লাহ, সৈয়দ আহমেদ বাকের, শিবনারায়ণ দাশ প্রমুখের সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন সংযোজন করা যায় কিনা লেখক একটু বিবেচনা করবেন। তাছাড়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ পরিমল দত্তের নামও প্রস্তাবে রাখছি।

বইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও পাঠাগারে সমাদৃত হলে লেখকের এই কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টা সার্থক হবে। পুশসেল করেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পাঠাগারে বিক্রি করা যায় কীনা পরীক্ষা করা যেতে পারে। বইটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।
মোবাইল: ০১৭৩১-৫১২৭২২ এবং ০১৫৫২-৩২০৯৫৭