বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লা সফর

।। বাকীন রাব্বী।।
১৯৭২ সালের ৪ জুলাই, সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন কুমিল্লায়। তিনি কুমিল্লাবাসীর উদ্দেশ্যে জনসভায় ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বি। আল্লাহ্ র পর যাঁর নামের উপর ভরসা করে, যাঁর আহ্বানে সমগ্র জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে মহান নেতাকে দেখতে, তাঁর কথা শুনতে কুমিল্লার লাখো মানুষ উন্মুখ হয়েছিল।
কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতারা এবং প্রশাসন দেখলেন জনসভার জন্য কুমিল্লা টাউন হল বা স্টেডিয়াম মাঠ পর্যাপ্ত বড় নয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় বর্তমান হাউজিং এস্টেটে জনসভা আয়োজন করা হবে। ১৯৭২ সালে হাউজিং এস্টেট একটা খালি ময়দান ছিল। এর অনেক পরে এখানে অবকাঠামো গড়ে উঠে।
সকালে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার যোগে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্ মাঠে এসে নামলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এ সময়ে উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে সাংবাদিক হিসেবে ছবি তোলার জন্য আমি, আমার আব্বা, পিআইডি এবং বিটিভি’র একজন করে ফটোগ্রাফার ছিলেন। তখন কুমিল্লার পুলিশ সুপার ছিলেন ইসমাইল হুসেইন (পরবর্তী সময়ে আইজিপি)। কুমিল্লা পুলিশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড-অব-অনার দেয়া হয়। তিনি সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। আমি ও আব্বা উভয়েই সেই ছবি তুলেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের সেই ছবিটির একটি মুর‌্যাল ২০১৭ সালে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে স্থাপন করা হয়। কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার শাহ্ মোহাম্মদ আবিদ হোসেনের উদ্যোগে সুন্দর এ কাজটি হয়।মামুন সিদ্দিকীর পরামর্শে আবিদ হোসেন সাহেব আমার কাছ থেকে ঐ ছবিটা চেয়ে নিয়েছিলেন মুর‌্যালের কাজে ব্যবহারের জন্য। সেখানে যদি ফটো: মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী অথবা ছবি বাকীন রাব্বীর সৌজন্যে লেখা থাকতো তাহলে বিষয়টা আরও নান্দনিক হয়ে উঠত।
বঙ্গবন্ধুর কথায় ফিরে আসি। বিশাল দেহের লোকটার হৃদয়টাও যে কতো বিশাল ছিল একটি কথা থেকে তা বুঝা যাবে। তিনি যখন পুলিশ লাইনস্ থেকে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সার্কিট হাউসে আসার জন্য গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন তখন ভিড়ের মধ্যে আমি বঙ্গবন্ধুর যথাযথ ছবিটা নিতে পারছিলাম না। আমার এ অসহায়ত্ব দেখে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- ছেলেটা আপনার একটা ছবি নেয়ার চেষ্টা করছে, তাকে একটা পোজ দেন। একথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁর মুজিব কোটে হাত দিয়ে স্মিত হেসে আমাকে একটা পোজ দিয়ে বলেছিলেন- নাও, ছবি নাও, আমি দাঁড়ালাম। যেহেতু সেটা ছিল একান্ত আমার জন্য পোজ দেয়া বঙ্গবন্ধুর ছবি, সেহেতু এটার গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম। আমার হাতে তোলা তাঁর অন্যান্য ছবির মধ্যে এ ছবিটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিকেলে হাউজিং এস্টেটের জনসমুদ্রে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু কুমিল্লা শহরে আর না এলেও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কয়েকবারই এসেছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে, যখনই তিনি কুমিল্লা এসেছিলেন প্রতিবারই তাঁর ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম পাসিং আউট প্যারেডে তিনি সালাম নিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ ক্যাডেটকে সোর্ড অব অনার দেয়ার ছবিটাও আমার সংগ্রহে আছে।
১৯৭৩ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু সালাম নিচ্ছেন, পেছনে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ ও তৎকালীন কর্নেল জিয়াউর রহমান (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট)। আমার হাতে তোলা এ ছবিটা ফেসবুক থেকে নিয়ে চট্টগ্রামের একটি সংগঠন ফটো ক্রেডিট ছাড়া প্রিন্ট করে বিক্রি করে আসছে, যা দুঃখজনক।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক আমোদ।