খাবার বিতরণ ও চিকিৎসা সেবায় তার ৫০বছর

 

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
বয়স ৭৮বছর। হার্টে অপারেশন হয়েছে। শরীরে নানা রোগের ঘর-বাড়ি। এখন অবসরে এসেছেন, নেই তেমন আয়। তারপরেও তিনি থেমে নেই। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বই খাতা দেয়া,খাবার ও কাপড় বিতরণ করা। অন্যের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে দৌঁড়ানো । গরিব মেয়েদের বিয়ের আয়োজন করায় তার সময় কাটে। সেবা করতে গিয়ে সংসার করেননি। জীবনের প্রায় ৫০ বছর এভাবে কুমিল্লা নগরীতে তিনি অতিবাহিত করছেন। তিনি মনে করেন,তার আশপাশের কম ভাগ্যবান মানুষ গুলোই তার পরিবার। তিনি অনিমা মজুমদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা ফরিদা বিদ্যায়তনে শিক্ষকের চাকরি নেন। ২০০৬সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। শিক্ষকতার সাথে তিনি মধুমিতা কচিকাঁচার মেলার সাথে ৬০বছর ধরে জড়িত। এখন পরিচালিকার দায়িত্ব পালন করছেন। নারীদের কল্যাণে গঠিত সারোদা সংঘের তিনি সম্পাদিকা।
১৯৪৬সালে তার জন্ম নগরীর বাগিচাগাঁওয়ে। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ষোলদোনায়। বাবা স্কুল শিক্ষক শ্রীনাথ মজুমদার। মা চারুপ্রভা মজুমদার। চার ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি ৭ম। বেঁচে আছেন এক ভাই দুই বোন। তাদের চার ভাই বোন বিয়ে করেননি। বিয়ে না করা অন্য তিনজন হচ্ছেন রাঙ্গুনিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বিমেলন্দ্র নারায়ণ মজুমদার,পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক একাউন্টেন্ড প্রয়াত সুনীল বরণ মজুমদার ও প্রয়াত শান্তিময়ী মজুমদার। আমেরিকায় আছেন ছোট বোন নীলিমা দত্ত। তিন বিয়ে করেছেন।
বাগিচাগাঁওয়ের বাসায় নির্মাণ কাজ চলছে। তারা এখন ভাড়া থাকেন নগরীর লাকসাম রোডের একটি বাসায়।
বাসায় গিয়ে দেখা যায়, রান্নার সহকারীসহ ৫জন মানুষ। অনিমা মজুমদার, তার ভাই বিমেলন্দ্র মজুমদার,তাদের মামাতো ভাই দীপংকর গুহ, ফুপাতো বোনের মেয়ে স্বরসতী মজুমদার মিলে সংসার। বিমেলন্দ্র মজুমদারের বয়স ৯০এর কাছাকাছি। তিনি বই পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। অনিমা মজুমদার ও স্বরসতী মজুমদার রান্নায় সময় দিচ্ছেন। দীপংকর গুহ কাঁচা বাজার নিয়ে এসেছেন। ফ্লোরে ও বিছানায় বই পত্রিকা হামাগুড়ি দিচ্ছে। ফাঁক পেলে অনিমা মজুমদারও বই নিয়ে বসছেন।
জীবনের টার্নিং পয়েন্টের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, রানীর বাজার এলাকার রামচন্দ্র পাঠশালায় ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। বর্তমানে স্কুলটি নেই। পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় তাকে একদিন স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো। তিনি রাগে ক্ষোভে বাড়ি ফিরেন। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেন কেউ যেন টাকার অভাবে পড়ায় সমস্যায় না পড়ে। সেই স্কুলে তার রুল নং ছিলো দুই। এক রুল ছিলো এক জেলা জজের ছেলের। তার নাম এনামুল হাসিব। তিনি তাকে এখনও খুঁজে ফিরেন। বেঁচে আছেন কিনা জানেন না।
পরিবারের বিষয়ে বলেন,ভাই বোন বেশি। বাবার কম আয়। এরমধ্যে ১৯৭১সালে পাকিস্তানিরা মামা পরেশ চন্দ্র গুহকে মেরে ফেলেন। লক্ষীপুরের বড়ালিয়ায় মামার বাড়ি। তার সাত ছেলে মেয়ে। তাদের এখানে থেকেই তারা বেড়ে উঠেন। ১৫জন ভাইবোনের দায়িত্ব মা-বাবার পর তাদের ওপর পড়ে।
ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় শিক্ষকতার প্রেমে পড়েন। ইংরেজির শিক্ষক লায়লা নূর ম্যাডাম ও বোটানির জাহানারা মুন্সী। তারা অনেক দারুণ করে পড়াতেন। বিশেষ করে লায়লা নূর হাতে বই নিয়ে হলে হাঁটার দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।
সেবার বিষয় আসে মা থেকে। সংসারে এত টানাটানি। তবুও মাকে দেখতাম রান্নার সময় একটা পিয়াজ,একটা রসুন বা একটু চাউল কাগজে মুড়িয়ে রাখতেন। পরে কেউ চাইতে এলে দিতেন। তখন দেখে রাগ লাগতো। এখন বুঝি এই দেয়ায় কত আনন্দ!
স্কুলে চাকরি হওয়ার পর সেবার আনন্দ পুরো পেতে শুরু করি। পুরাতন বই কিনে শিক্ষার্থীদের দিয়েছি। নিজের বেতন থেকে শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফি। এখন চাকরি নেই। মানুষ থেকে চেয়ে এনে দেই। কিভাবে যেন স্রষ্টা মিলিয়ে দেন।
এখন সময় কাটে শুক্রবার ও শনিবার বিকাল ৪টা-৬টায় ফরিদা বিদ্যায়তনে কঁচিকাচার মেলার শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম করে। অন্য সময় মানুষের জন্য কাজ করে। এই কাজেই জীবনের আনন্দ খুঁজে পাই।
সিসিএন বিশ^বিদ্যালয়ের লিবারেল আটর্স অনুষদের ডিন ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, তাকে কাছ থেকে দেখছি। এমন মানুষ বিরল। নিজের পরিবার চালাতে হিমশিম খান, তার মধ্যে অন্যের খাবার সংগ্রহ ও সেবার জন্য প্রতিদিন ছুটে বেড়ান।
কুমিল্লা ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ সেলিম বলেন,এমন সেবা পাগল মানসিকতার মানুষগুলোর জন্যই সমাজ এখনও এত সুন্দর। অনিমা মজুমদার মাতৃস্নেহে তার চারপাশ আগলে রাখেন।
প্রবীণ ব্যবসায়ী খাদিঘরের স্বত্ত্বাধিকারী প্রদীপ রাহা কান্তি বলেন,তিনি শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। শিশুর মতো কোমল মনের অধিকারী। তার হাত ধরে অনেক শিশু আলোর পথ দেখেছে। তার মাতৃস্নেহেও সমাজের মানুষ উপকৃত হচ্ছে।