৬৬ বছরে কুমিল্লার ‘আমোদ’

অনলাইন ডেস্ক ।।

কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ ২০২০সালে ৬৬ বছরে পা দিল । নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাপ্তাহিকটি পাঠক প্রিয়তার পাশাপাশি বস্তুনিষ্ঠতার মান ধরে রেখেছে। প্রাচীনতম সাপ্তাহিক হিসেবে এর সুনাম সবখানেই। স্বীকৃতিও পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। ৬৩ বছর পর্যন্ত সাদাকালোতেই এর সংবাদ, ছবি, মতামত ছাপা হতো। এখন রঙিন ‘আমোদ’ আমোদিত করছে কুমিল্লাবাসীকে।

‘আমোদে’ থাকে সব টাটকা, ব্যতিক্রমী ও সাহসী সংবাদ। বৃহস্পতিবার এলেই শহরবাসী হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ‘আমোদ’ কেনে। আমোদে কী আছে? কেন এর পাঠকপ্রিয়তা? কীভাবে টিকে আছে এটি? এমন প্রশ্নের জবাব মেলে ‘আমোদ’–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বীর কাছে। তিনি বলেন, ‘পাঠকের চাহিদা আর বাবার আদর্শকে লালন করেই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি এগিয়ে চলছে। ভালো প্রতিবেদন থাকলে পত্রিকা রঙিন কি সাদাকালো, সেটা কোনো বিষয় না। কিন্তু এখন রঙিন ছাপা হয়। এর প্রতিবেদন, মতামত এবং কুমিল্লার উত্তর জনপদের খবর বেশি ছাপা হওয়ার কারণেই এর চাহিদা অনেক।’

পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ছিলেন খেলাধুলাপ্রেমী। খেলার মাঠেই তাঁর সময় কাটত। তখন তিনি খেলার ধারাবর্ণনা করতেন। হঠাৎ করেই মাথায় এল ক্রীড়াবিষয়ক একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা করবেন তিনি। ১৯৫৫ সালের ৫ মে উদ্বোধনী সংখ্যা বের হয়। আকার ট্যাবলয়েড। ছাপা হতো ট্রেডেল মেশিনে। তখন দাম ছিল এক আনা। এতে পূর্ব পাকিস্তানের সব খেলার খবর ছাপা হতো। বছর তিনেক চলার পর মনে হলো, এত খেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন কিছু করতে হবে। খেলার খবর ছাড়াও বাইরের সব ধরনের খবর ছাপতে হবে। তখন কুমিল্লার সিনেমা হলগুলো দর্শকে ঠাসা ছিল। সম্পাদক সিনেমা হলে যেতেন। ছবি দেখতেন। এরপর ছবির রিভিউ লিখে বেশ সাড়া পান। তখন ছবি নিয়ে মজাদার লেখা পাঠককে আকৃষ্ট করত। এ অবস্থায় পত্রিকাটির কাটতি বেশ বেড়ে গেল। ওই পত্রিকা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা ও সোনামূড়াতে যেত। ওই পত্রিকা বিক্রি এবং এর বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর পরিবারের খরচ চলত।

১৯৫৫ সালের ৫ মে পত্রিকাটি বের হলেও নিজস্ব প্রেস থেকে পত্রিকা ছাপা হয় ১৯৬৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ডাবল ডিমাই সাইজের চায়নিজ  মেশিনের মাধ্যমে তা বের হতো। বর্তমানে পত্রিকাটি নিজস্ব অফসেট প্রিন্টের মেশিনে ছাপা হচ্ছে।

‘আমোদ’–এর স্বীকৃতিও কম নয়। ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো থেকে এশিয়া মহাদেশের সব আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ওপর একটি জরিপ কাজ চালানো হয়। ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে ড. ক্রিসপিন সি মাসলগ ওই জরিপকাজ চালান। ওই সময়ে তিনি ১০টি আঞ্চলিক পত্রিকার ওপর কাজ করে পাঁচটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে সফল হিসেবে ইউনেসকোতে প্রতিবেদন দেন। এতে বাংলাদেশের ‘আমোদ’ ছিল। তখন ‘ফাইভ সাকসেসফুল এশিয়ান কমিউনিটি নিউজ পেপার’ নামে একটি বই বের হয়। তার মধ্যে কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৩-০৪ সালে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ আমোদ’–এর ওপর আলাদা অনুষ্ঠান প্রচার করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আমোদ ১০ হাজার কপি বের করে।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমোদও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে দুই সপ্তাহ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ২৮ সপ্তাহ এবং ১৯৭৫ সালে ১৪ সপ্তাহের জন্য এর প্রকাশনা সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়। কিন্তু কোনো ঝড়ঝাপটাই ‘আমোদ’কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ‘আমোদ’ কুমিল্লার প্রথম ওয়েবসাইট পত্রিকা। ২০০৬ সালে এটি ইন্টারনেটে পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ওয়েবসাইটে ‘আমোদ’ পড়া যাবে www.amodbd.com এই ঠিকানায়।

১৯৯৪ সালে পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী মারা যান। এরপর তাঁর স্ত্রী শামসুন নাহার রাব্বী পত্রিকার হাল ধরেন। শামসুন নাহার রাব্বী বলেন, ‘৪০ বছর ৬ মাস পত্রিকাটির প্রকাশনা দেখে গেছেন রাব্বী (তাঁর স্বামী) সাহেব। এটা অনেক বড় ব্যাপার। তিনি পত্রিকার সংবাদ লেখা, বানান ঠিক করা, ছাপানো, ভাঁজ করা—সবই করতেন।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘একদিন কুমিল্লার রূপালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গেলাম। তখন সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ আমাদের হলের মধ্যে চা খাওয়াল। হঠাৎ করে তিনি আমাকে বললেন, এটা নিয়ে একটি নিউজ করো। ওনার পীড়াপীড়িতে লিখলাম, ‘সিনেমা হলে চা চক্র’। ওই লেখা বেশ সাড়া পড়ে গেল। ওই লেখার মধ্য দিয়ে আমিও সাংবাদিকতায় নাম লিখলাম। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি, তাই একমাত্র ছেলেকে (বাকীন রাব্বী) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

১৯৮৫ সালের ৫ মে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী হলেন প্রধান সম্পাদক। তাঁর স্ত্রী শামসুন নাহার রাব্বী হলেন সম্পাদক। তখন পত্রিকার দাম ছিল ৭৫ পয়সা। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা।

‘আমোদ’-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মহিউদ্দিন মোল্লা বলেন, কুমিল্লা শহরের সব পত্রিকা রঙিন। এর মধ্যে ‘আমোদ’ সাদাকালোতে ৬৩ বছর ছিল। কয়েক বছর ধরে রঙিন বের হচ্ছে।  আমোদ-এর পুঁজি সততা ও পরিশ্রম।

কুমিল্লার প্রবীণ সাংবাদিক খায়রুল আহসান মানিক বলেন,গত ৬৬ বছর কুমিল্লা ও আমোদ হাত ধরাধরি করে চলেছে। আমোদ কুমিল্লার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। সাপ্তাহিক আমোদ-এর মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করি।

সম্পাদক বাকীন রাব্বী বলেন,প্রতিটি মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে- একটি নতুন দিনের জীবন পেলাম। তেমনি আমরা প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে আমোদ পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর হাফ ছেড়ে বলি- আরেকটি সপ্তাহ পত্রিকা প্রকাশ করতে পারলাম। পেশা ও নেশার সাথে সংবাদপত্র প্রকাশনা আমাদের নিকট ইবাদতের মতো। মানুষের ভালোবাসার কারণে এ দীর্ঘ সময়ের পথ পাড়ি দিতে পেরেছি।

বিজ্ঞাপন