আমাদের সামাজিক বন্ধন ও করণীয়

।। মো. আলী আশরাফ খান ।।
আমাদের সামাজিক বন্ধন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অথচ আজকাল এই বিষয়টির প্রতি আমাদের তেমন গুরুত্ব নেই বললেই চলে। অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, এখন ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক বা বন্ধন দুর্বল কিংবা ভেঙ্গে পড়ার কারণে সমাজ জীবনে নানা বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ, ব্যক্তি ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক সুমধুর করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সভা-সমিতি সর্বোপরি সংগঠনচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।
আমরা অনেকে মনে করি, শুধু আইন ও পুলিশের তদারকি দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আসলে তা সঠিক নয়। এটি সমাজে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-পরিবারের প্রচেষ্টা, সামাজিক পরিবেশ তৈরিতে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এবং এতে করে পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ টেকসই, মজবুত ও শক্তিশালী হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী থাকে  নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে,পাড়া-মহল্লার ও এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সূচনা হাজার বছর আগে থেকেই। যদিও কখনো কখনো গুরুত্বের বিচারে আমরা কোনটিকে ছোট আবার কোনটিকে বড় করে দেখছি। আসলে এসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ-তা অকপটে বলা যায়। এক পক্ষের ব্যর্থতা কিংবা সফলতা অন্য পক্ষকে বেশি নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সমীচীন নয়।
এখন আগের তুলনায় আমাদের তথ্য জানার সুযোগ বেড়ে গেছে। কোনো বিষয়ে মতামত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগও অনেক বেশি। একসময় এসবের জন্য সংবাদপত্র ছাড়া তেমন কোন মাধ্যম ছিল না বললেই চলে। কালের পরিক্রমায় সব কিছুর পরিবর্তন লক্ষণীয়। কোন তথ্য দ্রুত গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন চলে আসে তখন প্রতিক্রিয়া আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। আজকাল জাতীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলা-জেলা শহর থেকেও দৈনিক ও অনলাইন পোর্টাল প্রকাশ হয়। তাছাড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর ফেসবুকের মতো অবাধ মাধ্যম তো রয়েছেই।
এসব মাধ্যমগুলোয় একাডেমিক দিক থেকে আমরা সফল হচ্ছি। নিজেদের মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতেও পারছি। আমরা ব্যক্তি যখন সমাজের এমন মাধ্যমগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি, তখন তার মতামত ও প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তা কারো কারো বিরাগভাজনের কারণ হয়। তবে এসব মতামত ও প্রতিক্রিয়া গঠনমূলক হলে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনলে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবি রাখে। আর যদি তা কারো সম্মানহানি কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হয়, তখন নি:সন্দেহে এটি অপরাধ হিসেবে ধরে আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়ে। এবং তাকে শাস্তি পেতে হয়।
ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক ও বন্ধন সুদৃঢ়করণের জন্য গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
শতভাগ সঠিক তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব। আমরা মনে করি, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের বন্ধন বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিরাজমান বৈরী আইনের শাসন ও নীতিহীন সমাজব্যবস্থা। এব্যাপারে যতই আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা হউক না কেন, যদি আইনের সুশাসন বাস্তবায়ন করা না যায়, এর প্রতিফলন ঘটবে না-তা হলফ করে বলা যায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আস্থার জায়গা তৈরি করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত করতে এর কোন বিকল্প নেই। তবে সব ক্ষেত্রে এর দায় শুধু সমাজ-রাষ্ট্রের উপর চাপানো যাবে না। সর্বাগ্রে আমি ব্যক্তিকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমি ব্যক্তি কোনোভাবেই সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে আলাদা নই। যদিও নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে আইনের শাসনের মধ্যে। তবুও ব্যক্তিকে জাগরণের বীজটি বপন করতে হবে আমাকেই। আর তাতে করে আমাদের চলমান জীবনে সম্পর্ক-বন্ধন সুন্দর-সুমধুর হবে। সমাজ উন্নত হবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা-অপরাধ থাকবে না।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সংগঠক 
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।