আমার চোখে মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো

।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।
“এমন বিপ্লব কোথাও দেখেনি কেঊ”—অকাল-প্রয়াত কিশোর বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অবিস্মরণীয় কবিতার একটি লাইন । মহান রুশ বিপ্লবের বা অক্টোবর রিভোলিউশানের প্রেক্ষাপটে লিখিত কবিতাটি প্রত্যেকটি বাঙালীর হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল তখন। অপূর্ব অসাধারণ এই কবিতাটি আজও বিপ্লব যেখানেই, মানে বিশে^র যেকোন প্রান্তে বা দেশে, সংগঠিত হোক না কেন তাৎপর্য বহন করে এবং যথাযথ বলে বিবেচিত হয় ।
মহান অক্টোবর রিভোলিউশান বা রুশ বিপ্লব প্রত্যক্ষ্য করবার প্রশ্নই ওঠেনা । কিন্তু আমাদের দেশে ঊনিশ’শ একাত্তর সালের মার্চে তেমনি যে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ্য করবার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা শহরে অবস্থান করে। তখন সবেমাত্র একুশ বছরের টগবগে তরুণ । বি.এসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রথানুযায়ী বা পদ্ধতিগত পাঠক্রমের ওপর জোর দিয়ে পড়াশুনায় নামমাত্রই মন বসছেনা। কেননা উত্তাল মার্চের প্রথম দিনটি থেকেই দেশব্যাপী সব্বাই-ই একটি অসম্ভব রকমের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনজোয়ার প্রত্যক্ষ করছে। রাস্তায় রাস্তায় সড়কে মহাসড়কে গগনবিদারী শ্লোগানে শ্লোগানে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করছে । দেশমাতৃকার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে ।
ইতোমধ্যে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সর্বস্তরের, আবারো বলছি প্রকৃতঅর্থেই সব শ্রেণী-পেশা-আদর্শের মানুষ মাত্রই, সেই অমোঘ বজ্রনির্ঘোষে অকুন্ঠ সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। এমনকি যারা ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনাতিপাত করতে অভ্যস্ত তারাও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব্বাই এক কাতারে সমবেত হয়েছেন । দেশকে বিদেশি পাকী অপশাসন-শোষণ-বঞ্চনামুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জনকল্যণমূলক রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে ।
সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য-তা বোধকরি কোন লেখায়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা একটি নেস্ট টু এ্যান ইমপসিবল টাস্ক-প্রায় অসম্ভব একটি প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ বলেই গণ্য হবে। আমাদের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো ছিল এ্যান এক্সপেরিয়েন্স অব আ লাইফটাইম । আজীবনের অম্ল-মধুর-স্বর্ণখচিত অভিজ্ঞতা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ এবং হীরকখচিত ঘটনার অভিজ্ঞতা হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা সবার জীবনে আসেনা ।
ঢাকার মতো সেদিনকার মিছিলকারীদের কন্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান–“তোমার নেতা আমার নেতা-বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু”, “তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা ঢাকা”, “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, সোনার বাঙলা স্বাধীন কর” “জল্লাদ ইয়াহিয়ার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে” ইত্যাদি । শ্লোগানে শ্লোগানে তখনকার পথ রাজপথ সড়ক প্রকম্পিত হতো । সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে বাসায় বসে কি লেখাপড়া সম্ভব ! তাইতো আমরা সেসময়কার সব তরুণ তুর্কীই ছুটে যেতাম মিছিলে অংশ নিতে। সবদিক থেকেই খ- খ- মিছিল বের করা হতো। বলতে গেলে সেইসব দিনে পুরো শহরটাই মিছিলের শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল । কুমিল্লা রেল স্টেশন থেকে কান্দিরপাড়, কান্দিরপাড় থেকে রাজগঞ্জ । কখনো সখনো চকবাজার পর্যন্ত মিছিল পৌঁছে যেত । জনগণকে সর্বোতভাবে সংগ্রামে সম্পৃক্ত করবার লক্ষ্যে । বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলমান অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার অভিপ্রায়ে ।
কুমিল্লা শহরের এমন কোন প্রধান প্রধান সড়ক বাকি ছিলনা যেখান থেকে মিছিলে মিছিলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এই জনপদ উত্তপ্ত হয়নি সেদিন। এমনকি বাদশা মিঞার বাজার চৌমুহনী থেকে মিলেট রোড, এখনকার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজাম উদ্দিন সড়ক, দিয়ে বিরাট মিছিল বের হতো প্রতিদিন । প্রায় সব মিছিলেরই গন্তব্য ছিল টাউন হল । (তখনো বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও গণপাঠাগার হিসেবে পুন:প্রতিষ্ঠা করা যায়নি ।) মিছিল শেষে টাউন হলের দুপাশে দুটো মাঠেই গণজমায়েত হতো। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদ এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ওই অনির্ধারিত জনসভায় ভাষণ দিতেন । ছাত্র ইউনিয়ণ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গণসঙ্গীত পরিবেশন করতেন জনগণকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত করবার লক্ষ্যে ।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী গোটাকয় নাট্য সংগঠন বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর পাকী অপশাসন, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নিগ্রহ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে উপজীব্য করে টাঊন হল রঙ্গমঞ্চে বা হলের বাইরে নির্মিত খোলা মঞ্চে নাটকও পরিবেশন করতো সেসময় । এমনি একটা নাটকে জল্লাদ জেনারেল টিক্কা খানের গণধীকৃত ভূমিকায় অভিনয় করে আমাদের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ের বড়ভাই সম্প্রতি প্রয়াত মনিরুল ইসলাম নঈম, যিনি নঈম মামু হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন, স্থানীয় প্রশাসনের কোপানলে পড়েছিলেন । হাজারো হাজারো জনগণের উপস্থিতিতে প্রাচীন এই শহরটি মুখরিত ও প্রকম্পিত হতো তখন ।

কিন্তু হঠাৎ করেই শহরটার পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে গেল । আরো অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো যেন । ৭ই মার্চের পর । সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনসহ স্বাধীনতা ঘোষণার ইঙ্গিতবহ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেই অন্ততপক্ষে অধিকাংশ জনগণই বুঝে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রচ্ছন্নভাবে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাই করে দিয়েছেন ।

পাকী সামরিক জান্টা সমর্থিত সরকার জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (সিসেশানিষ্ঠ মুভমেন্ট) হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে যাতে করে অপপ্রচার চালাতে না পারে সেজন্যেই বঙ্গবন্ধু ওই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের মহাসমাবেশ থেকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি সেদিন । রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন । কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ডামী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক মহড়া দেয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল । কুমিল্লায় আমরা দেখেছি ভিক্টোরিয়া কলেজের ইউওটিসি (ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর্স) অফিসের সামনে টেনিস খেলার জন্য নির্মিত কোর্টে ডামী অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও চালু করা হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুর এই প্রচ্ছন্ন স্বাধীনতার বাণী সম্বলিত ভাষণে জনগণ এমনভাবে অভিভূত, উদ্বেলিত ও মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল যে তারা যার যা আছে তাই নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ।
তারপরের ২৫ মার্চের কালোরাত, পাকী বাহিনীর ঘুমন্ত বাঙালীদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা সংগঠন এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাসহ বিয়োগান্তক, মর্মান্তিক, ভয়াবহ ও বেদনাবিধুর এবং ত্যেজোদীপ্ত ঘটনাপ্রবাহ কমবেশি সব্বারই জানা আছে। তাই সবিস্তার বর্ণনায় যাইনি। পাঠকদের ধৈর্যের ওপর অবিচার হবে বলে ।
তবে, ২৬ মার্চের খুব সকালে কান্দিরপাড় চৌমুহনীতে পাকী দখলদার বাহিনীর বর্বরতার নিদর্শন কুমিল্লা শহরের প্রথম শিকার নাম-না-জানা ইউসুফ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রটির লাশ হওয়ার নির্মম দৃশ্য অসহায়ের মতো প্রত্যক্ষ করেছিলাম। পরে জেনেছিলাম পাক হানাদার বাহিনীর একটি সামরিক ঘাতক দল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সদ্য আমদানীকৃত চায়নিজ সমরাস্ত্রের চালান নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে যাবার পথে শ্লোগানময় জনতাকে শায়েস্তা করতে টমিগান দিয়ে গুলি করলে আমাদের ছোটভাইটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ের বড়ভাই নৃপেন্দ্র পোদ্দারের ছোটভাই ভূপেণকে অকুস্থল থেকে কুমিল্লা শহরের প্রথম শহীদভাইটির বুলেটবিদ্ধ, রক্তাক্ত ও নিথর মৃতদেহ বুকে তুলতে দেখে একটা শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল সেসময়ে । বুকে বিদ্ধ হয়ে ছোট একটা ছিদ্র করে পিঠ দিয়ে বিরাট গর্ত করে বুলেটটা বেরিয়ে গিয়েছিল, দেখেছি । কিছুই করার ছিলনা অগ্রসরমান ঘাতক বাহিনীর সামনে। তাই ঘটনার বীভৎসতা দেখে প্রাণভয়ে সেসময়ে কান্দিরপাড় এলাকা থেকে পালিয়ে যাই । বন্ধুবান্ধব যারা সেসময় আমার সাথে ছিল তাদের নিয়ে । এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত উত্তেজিত জনতা কান্দিরপাড়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রিড সাব-স্টেশানের একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুটা ভাংচুরও হয়েছিল মনে পড়ছে । এই পিকআপ গাড়িটা কুমিল্লার অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলোয়াড় ওয়াসেক আলী খানের ছোটভাই প্রকৌশলী গওহর খান ব্যবহার করতেন দাপ্তরিক কাজে ।
গতকাল (২০/০৩/২৩ খ্রি) আমাদের প্রিয় ভাইপো ও কুমিল্লার অন্যতম প্রখর তরুণ ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর জানালো কুমিল্লার প্রথম শহীদ ভাইটির নাম আবুল হোসেন। মাত্র ১৪ বছরের এক সম্ভাবনাময় কিশোর । এ ব্যাপারে বেশিকিছু আর তথ্য সে দিতে পারেনি । বায়ান্ন বছর পর এই মার্চ মাসে স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে যথাযথ বিহীত ব্যবস্থা নেবেন বলে প্রত্যাশা করছি ।
সেই শহীদ ছোট্টভাইটিসহ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মউৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদদের স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি । সেই সঙ্গে জীবিত পঙ্গু-অস্বচ্ছল ও অবহেলিত প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও মহান মুক্তিযুদ্ধে তিন লক্ষ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ৫৩তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে।
জয় বাংলা ! জয় বঙ্গবন্ধু !!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন : ০১৭৩১-৫১২৭২২ ও ০১৫৫২-৩২০৯৫৭