আমার লাল সাদা রঙের  সাইকেলটা!

পুতুল আক্তার রলি।।
ছোট থেকে নতুন কিছু শিখার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল।আমার বড় ভাইয়ের একটা মাঝারি আকারের সাইকেল ছিল।ভাই যখন এটা নিয়ে বের হত তখন ভাবতাম কি করে ভাই এটা চালায়!আমিও যদি ভাইয়ের মতো করে চালাতে পারতাম!প্রায়ই এই ভাবনাটুকু আমার মাথায় আসতো।আমি খুব সূক্ষভাবে খেয়াল করতাম কিভাবে এটা চলে।ভাই যখন সাইকেল রেখে এদিক সেদিক যেতো তখন আমি সাইকেলটার কাছে গিয়ে খুব আগ্রহের সাথে তার দিকে তাঁকিয়ে থাকতাম।
কখনো প্যান্ডেলটা হাত দিয়ে ঘুরাতাম,কখনো বা অকারণেই বেলটা জোরে জোরে বাজাতাম।ভাইকে খুব ভয় পেতাম তাই তার সামনে তার সাইকেলে ধরতাম না। যাই হোক তখন ছিলো শীতকাল! ভাই হটাৎ আন্টিদের বাড়িতে বেড়াতে গেলো কয়েক দিনের জন্যে।আমি ভাবলাম এইবার সাইকেলটাকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারবো। তাই কিছুটা ভয়ের সাথে ধিরে ধিরে এটাকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির পাশে একটা খালি জায়গায় নিয়ে গিয়ে  সাইকেলের মাঝখানে যে একটা ফাঁকা যায়গা থাকে অইটা মধ্যে দিয়ে ডান পা ঢুকিয়ে সেদিন প্যান্ডেলে প্রথম পা লাগালাম।কিছুটা অস্বস্থিও বোধ করছিলাম। কিন্তু ইচ্ছাশক্তিটা ছিলো প্রখর।এইভাবে আস্তে আস্তে এক পায়ে ভর করে অন্য পা দিয়ে প্যান্ডেল চেপে সাইকেলটাকে এগিয়ে নেওয়ার চেস্টা করতে থাকলাম বিরতিহীন ভাবে।তখন বেশ কয়েকবার ঠাস-ঠুক করে গাছের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকলাম।যদিও ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কাঁদি নি।
 যখনি সাইকেল নিয়ে পড়ে যেতাম তখন এদিক সেদিক তাঁকিয়ে দেখতাম কেউ আমার পড়ে যাওয়াটাকে দেখলো কি না! যদি কেউ না দেখতো তাহলে ত বেঁচে যেতাম।আর কেউ দেখলে তার দিয়ে তাকিয়ে আমিও হাসতে থাকতাম।এইখানে কিছু দিন আম্মা,বাপ এর আঁড়ালে সাইকেল চালানো শিখার চেস্টা করতে থাকলাম।হটাৎ একদিন আম্মা আমাকে সাইকেল সহ দেখে বললো”””””আয় হায় রে!আত পাউ ডি ভাঙ্গনের  লাইজ্ঞা দেহো কিতা শুরু হরছে।আত পাউডি ভাংলে আর “বে” ও দিতারতাম না।সাইকেলডা থইবে থইবে না আমি কইঞ্চাডা লইয়া আইতাম!উত্তরে আমি”””আম্মানা আম্মানা আর ইকটু চালাইয়া বাদে থইয়াদেম”””তখন আম্মা কিছুটা রাগ দেখিয়ে আবার চলে যায়।
আম্মায় হয়তবা চাইতো যে আমি এটা শিখি।না হয় তখন চলে না গিয়ে আমার কাছ থেকে সাইকেলটা নিয়ে রোমে রেখে দিয়ে আমাকে মার কিল ও দিতে পারতো হয়তবা।কিন্তু আম্মা তা করেনি।এইভাবে তিন চার দিন যাওয়ার পর সাইকেলের নিচ দিয়ে কোন রকম চালাতে শিখলাম।কয়দিন পর ভাই চলে আসলো আন্টিদের বাড়ি থেকে।তাই যখন ইচ্ছে তখন আর সাইকেল বের করতাম না।যখন দেখতাম ভাই সাইকেল রেখে খেলতে গিয়েছে বা অন্য কোথাও তখন চুপিসারে সাইকেলটা বের করে সেই বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় নিয়ে পুনরায় শিখার চেস্টা। যখন মোটামুটি সাইকেলটা আমার আয়ত্বে আসলো তখন প্রায় ই চালানোর জন্যে বের করতাম।কিন্তু তখনো সাইকেলের উপরের সিটে বসে চালানো শিখি নি,তার সেই চেস্টা সফল করার জন্যে সুযোগ পেলেই সাইকেলটা বের করতাম।আম্মায় ও তখন তেমন কিছু বলতো না।কিন্তু যেন পড়ে ব্যথা নাই পাই সেই ব্যাপারে বার বার সতর্ক করতো।যাইহোক একদিন বাবা আমাকে সাইকেল নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে “”” কিরে তুই সাইকেল বার করছস কেরে?শিখতে? আমি যখন মুচকি হাসি দিয়ে  উত্তরে বললাম””হুম””। তখন বাবা বলবো তর ভাই যদি দেহে তুই তার সাইকেল বার করছস তে আর তর রক্ষা থাকবো না” বাবা আরো বললো “তুই কি পারস চালাইতে?”” আমি বললাম “” না এখনো তেমন ভালো পারি না,,সাইকেলের নিচ দিয়ে চালাতে পারি কোন রকম।তখন বাবা বললো “””” আচ্ছা আমি ধরি তুই উপ্রের সিটো বইয়া চালানির চেস্টা হর”” আমি ত এই কথা শুনে খুশি।তাই আর দেরি না করে বাবার কথা রাজি হয়ে তাকে বললাম সাইকেলটা শক্ত করে ধরার জন্যে।বাবাও তাই করলেন। অনেক্ষণ বাবা এইভাবে আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করেছে যাতে আমি সাইকেলের সিটে বসে তা চালানো শিখতে পারি।একটা সময় আমি তা পেরেও গেলাম।বাবা পাশে থাকায় আরো বেশি আআত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম তখন।আমার বাবা আবার খুব করে চাইতেন যেন আমি এটা শিখতে পারি।আমার বড় আপুকে সাইকেল চালানো আমার বাবাই শিখিয়েছিলো।আপুকে দেখেই অনুপ্রাণিত হওয়া। যাইহোক এইভাবে একদিন সাইকেল চালাতে শিখে গেলাম। তখন আমি স্কলার স্কিন্ডার গার্ডেন এন্ড প্রি ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি ভর্তি ছিলাম প্রথম শেণীতে।বাড়ি থেকে স্কুলটা দূরে ছিলো কিছুটা! বাবা একদিন আমার সামনে আম্মাকে বলতো লাগবো “” শুনো দিলোয়ারা,রলি অনেক দূরে ইস্কুলে যায়,ওরে একটা সাইকেল কিনে দিলে ত খুব কম সময়ে এলহা এলহাই ইস্কুলে যাইতে পারতো,তুমি কি কও? আমি যদি এক্সিডেন্ট করি সেই ভয়ে আম্মা তখন রাজি হতে চায়নি।কিন্তু আমার প্রতি বাবার একটা দৃঢ় ভরসা থাকায় আম্মাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে কিছুদিন পর একটা “”লেডিস সাইকেল কিনে দেয় ছয় হাজার টাকা দিয়ে।আমি ত খুব খুশি।আমাকে সাইকেল কিনে দেওয়ায় ভাই কিছুটা রাগ হয়েছিলো।
কারণ তখন গ্রামের কোন মেয়ে সাইকেল চালাতো না,আমি একা সাইকেলিং করলে কে কি বলে তা ভেবে ভাই আমাকে সাইকেল কিনে দিতে “না” করেছিলো। তার পরেও বাবা কিনে দেয়।আমি ত নতুন সাইকেল পেয়ে খুব খুশি।তখন ধিরে ধিরে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। সাইকেল নিয়ে যখন রাস্তায় বের হতাম তখন রাস্তার মানুষগুলো অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে থেকে আমার সাইকেল চালানোটা উপভোগ করতো।কেননা আগেই বলেছি তখন গ্রামের কোন মেয়ে নিজে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেত না।তাই আমার সাইকেল চালানোটা দেখার জন্যে অনেকের একটা বাড়তি আগ্রহ কাজ করতো।কেউ ইতিবাচক মন্তব্য করতো, কেউ বা নেতিবাচক। আমার ক্লাসের কিছু বন্ধু-বান্ধব বলতো “” কিরে তুই কি ছেরা নকিতা, ছেড়াইনের মতন সাইকেল চালাইয়া ইস্কুলে আইয়স কেরে” আবার কিছু মেয়েবন্ধু ছিলো যারা বলতো আহারে পুতুল আমি যদি তর মতো করে সাইকেল চালাতে পারতাম। কখনো আবার সাইকেলে করে ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে বাড়ি চলে যেতাম।
প্রতিবেশি কাকারা তা দেখে বাবা কে বলতো “”” ভাই তুমার এই ছেরিডের সাথে মাইনসের তিন চাইরডে ছেড়াও পারতো না,খুব দক্ষ তুমার এই ছেরিডে”””আবার কেউ বা বাবাকে বলতো মেয়ে মানুষকে কেন সাইকেল চালানো শিখাইছো,আবার সাইকেল দিয়ে স্কুলে পাঠাও এটা ঠিক না,মানুষ এটাকে খারাপ চোখে দেখে””ইত্যাদি। আমার বাবা তখন লোকের ইতিবাক কথাগুলোকে স্বাগত জানিয়ে নেতিবাচক কথাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলো।বাবা আমাকে সব সময় উৎসাহ দিতো আর বলতো কে কি বলে এইসব দেখলে জীবনে বেশী দূর এগুতে পারবি না।লোকের কথা কান দিস না।আমিও তাই করতাম। যাইহোক সাইকেল চালানো শিখেছিলাম তখন ঠিক’ই কিন্তু সাইকেলের পিছনে কাওকে বসিয়ে চালাতে পারতে না,অর্থাৎ ডাব্লিং করতে পারতান ন।তাই এটা শেখার প্রতিও বেশ আগ্রহ ছিলো।একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার এক ছেলে বন্ধু “দিদার”কে বললাম  দিদার তুই আমার সাইকেলের পিছনে বস তরে নিয়া ডাব্লিং করা শিখি।দিদার প্রথম উঠতে চায় নি ভয়ে! যদি তাকে নিয়ে উল্টিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে আমার সাইকেলে চড়াতে বাধ্য করলাম। সমতল জায়গায় দিদার কে নিয়ে ডাব্লিং করা শিখকে কস্ট হবে ভেবে অনেক উঁচু চিরাং বাজারের ব্রিজের উপর থাকে নিয়ে গেলাম।ওরে বললাম তুই শক্ত করে ধরে রাখিস ক্যারিয়ারে। তকে ব্রিজ থেকে নিজে নামতে পারবো খুব সহজে।বেশি শক্তি খরচা করে প্যান্ডেল চালাতে হবে না।এই বলে আল্লার নাম নিয়ে হালকা পরে পেন্ডেলে চাপ দিলেই চলতে শুরু করে সাইকেল,কিন্তু সাইকেলের সামনের অংশটা তখনো খুব বেশি নাড়াচাড়া করছিলো প্রথবার কাওকে তুলায়।ব্রিজ থেকে যখন নামতে শুরু করার সাথে দিদার অকারণে হাসি শুরু করে দিলো,ওর হাসি শুনে আমিও হাসতে শুরু করতাম।অতঃপর ব্রিজ থেকে অল্প একটু নামার পর ই দুইজন উল্টে গিয়ে পরলাম রাস্তার এক সাইডে।ব্রিজের সাইডে পুকুর ও ছিলো।ভাগ্য ভালো ছিলো তাই পুকুরে গিয়ে পড়ি নাই।সাইকেল আটিকে গিয়েছিলো একটা গাছে,আমি আর দিদার রাস্তার পাশেই পড়লাম।হাত পা এর চামড়া উঠে গেছিলো দুজনের’ই।দিদার ত আমাকে বকা বকি শুরু করলো।যাইহোক এইভাবে চেস্টা করতে করতে একদিন ডাব্লিং করাও শিখে গেলাম।
তখন থেকে সাইকেল নিয়ে যেখানে খুশি যেতাম।কখনো বা হাত  দিয়ে না ধরেই সাইকেল চালাতাম।সাইকেলের উপর তখন খুব ভালো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে।পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিত সাইকেলে করে স্কুলে যেতাম।ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পর কিছুদিন পর স্কুলে যাই সাইকেল চালিয়ে।কিন্তু কিছু নিন্দুক এর নেতিবাচজ মন্তব্যের কারণে এর পর থেকে আর সাইকেল নিয়ে কোথাও যেতাম না। যখন দ্বাদশ শ্রেনীতে পড়ি ময়মনসিংহের তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে “” বিশ্ব নারী দিবস  নারীদের সাইকেল র‍্যালির আয়োজন করা হলে পঞ্চাশজন  নারীর সাথে আমিও সেই সাইকেলিং এ অংগ্রহণ করি।এর পরে আর সাইকেল চালানো হয় নাই।বাইক চালানো শিখেছি তখন।সেদিন ই ছিলো সাইকেল চালানোর শেষ দিন।যদিও এখনো ভালো চালাতে পারি,ভুলে যাই নি।
কিন্তু সেই মধুর স্মৃতি গুলোকে বড্ড মিস করি। এইখানে যে স্মৃতিচারণ করেছি তার বাইরেও আমার সাইকেল নিয়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতি।আজো চোখে মধুর স্মৃতি হয়ে ভাসে আমার সেই শৈশবের লাল সাদা রঙের  সাইকেলটা!
পুতুল আক্তার রলি
শিক্ষার্থী : ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।
সদস্য, ক্যাম্পাস বার্তা