আমোদ-এর চাইতে বয়সে বড়!


।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।
বলছিলাম বৃহত্তর কুমিল্লা তথা বৃহত্তর নোয়াখালী এবং সিলেট জেলা অঞ্চল থেকে প্রকাশিত দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র সাপ্তাহিক আমোদ-এর চাইতে বয়সে আমি বড়। আমার দাবির সপক্ষে যুক্তিটি হলো, আমার জন্ম হয়েছিলো ১৯৫০ সালের দোসরা জানুয়ারি আর আমোদ পত্রিকা দিবালোক দর্শন করেছিলো ১৯৫৫ সনের পাঁচ মে। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে বা তর্কের খাতিরেও যদি একজন রক্ত-মাংসে গড়া ব্যক্তি এবং একটি পত্রিকার তুলনা করা যায় তবে অবশ্যই বলতে হবে আমি হেরে গিয়েছি। অবদান, অভিজ্ঞতা আর জনপ্রিয়তার কাছে। অবশ্যই আমাদের কুমিল্লার গর্ব এবং ঐতিহ্য সাপ্তাহিক আমোদ-এর কাছে।
আমোদ দেশের একটি অন্যতম সফল আঞ্চলিক সংবাদপত্রের মর্যাদা লাভ করেছে ১৯৮৫ সালে। সিলেটের অভিজাত এবং একসময়কার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যুগভেরীর সঙ্গে। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দ্য এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (এমিক) এশিয়ার সফল কমিউনিটি সংবাদপত্রের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে সেসময়। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পাঁচটি পত্রিকাকে এশিয়ার সফল আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এমিক। এ পাঁচটি পত্রিকার মধ্যে দুটোই ছিলো বাংলাদেশের। একটি কুমিল্লার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক আমোদ। অপরটি সিলেটের বিপুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যুগভেরী।
আর অন্য তিনটি পত্রিকার মধ্যে ফিলিপাইন, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ার সংবাদপত্র । ইউনেস্কোর (জাতিসংঘের শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা) হয়ে এমিক এ জরিপ কাজ পরিচালনা করেছিলো । দ্য ফিলিপিনস্-এর রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থিত এক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষককে এ জরিপ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর নাম ড. ক্রিসপিন সি মাসলগ । এমিক এ সংক্রান্ত একটা বইও প্রকাশ করেছিলো সেসময়ে। ফাইভ সাকসেসফুল এশিয়ান কমিউনিটি নিউজপেপারস্ নামে ।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণযোগাযোগ ইনস্টিটিউট এমিক আমাদের আমোদ এবং সিলেটের যুগভেরী পত্রিকাকে এশিয়ার অন্যতম সফল আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসেবে এ স্বীকৃতি দিয়েছিলো। হ্যাটস্ অব টু আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ভাই এবং জুগভেরী সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী। শেষোক্ত ব্যক্তি হলেন জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর ভাই। একবার আমোদ অফিসে কুমিল্লার ক’জন সাংবাদিকের সাথে কথা প্রসঙ্গে রাব্বী ভাই প্রয়াত আমিনুর রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের হৃদ্যতা ও বন্ধুত¦পূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের জানিয়েছিলেন। এই সম্পাদকদ্বয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম, দূরদর্শিতা, অসাধারণ মেধা এবং সঠিক ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশের মতো একটি তৃতীয় বিশে^র দেশ এ বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলো। এই দুই সফল ব্যক্তিত্ব আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সৎ জীবনযাপন করে ধান্ধাবাজি, বাটপারি ব্যতিরেকে এবং দলকানা না হয়েও বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ^স্ততার সঙ্গে সাংবাদিকতার মতো একটা মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করা যায়।
তাছাড়া, বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং সিলেট অঞ্চলের প্রথমে ক্রীড়া সাপ্তাহিক হিসেবে ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হলেও আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব¦ীর নেতৃত্বের গুণে, দূরদর্শিতা এবং পত্রিকা প্রকাশের সময়ে সংবাদগুলোর যথাযথ বস্তুনিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় উপস্থাপন পাঠকদের আকৃষ্ট করেছিলো। তাইতো, প্রকাশনার তৃতীয় বছরেই মানে ১৯৫৮ সালে প্রধানত: ক্রীড়া বিষয়ক বিশেষায়িত সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবাদ-নির্ভর মূলধারার পত্রিকাতে আমোদ-এর উত্তোরণ ঘটে। সেসময়ে প্রধানত: বৃহত্তর তিনটি জেলায়-ই আমোদের কাটতি সন্তোষজনক ছিলো। তুলনামূলকভাবে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত অন্যান্য সাপ্তাহিক পত্রিকার কাটতির সঙ্গে ।
প্রকাশনার অব্যবহিত পরেই এ অঞ্চলের পাঠক তথা জনগণেরও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গিয়েছিলো। তখন বড় ডিমাই আকারে বা ব্রডশিটে সাদা-কলোয় লেটার প্রেসে মুদ্রিত হয়ে আমোদ প্রকাশিত হতো। এখন যুগের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমোদের আকারও পাল্টেছে এবং রঙিন হয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে। প্রতি বৃহস্পতিবার ভোরে। ১৯৯৭ সাল থেকে আমোদ কম্পিউটার কম্পোজ হয়ে অফসেটে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত: দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে আমোদ অবশ্যই একটা অসাধারণ রেকর্ড করেছে। আর তা হলো, শত ঝড়ঝঞ্ঝা ও প্রতিকুলতার মধ্যেও ৬৮ বছর ধরে নিয়মিতভাবে এর প্রকাশ। যা দেশের আর কোন সংবাদপত্র রেকর্ড করতে পেরেছে কীনা আমার অন্তত: জানা নেই।
পত্রিকাটি অদ্যাবধি নিরপেক্ষ এডিটোরিয়েল পলিসি বা নিরপেক্ষ সম্পাদনা নীতি গ্রহণ করে প্রকাশিত হচ্ছে। তাছাড়া, এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিককে প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তবেই সাংবাদিকতায় তাদের হাতেখড়ি হয়েছে। বাকীন রাব্বী যখন পত্রিকাটির পূর্ণাঙ্গ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন সেসময় সহকর্মী হিসেবে কুমিল্লার প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক শাহজাদা এমরান, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং বর্তমান ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মহিউদ্দিন মোল্লা প্রমুখ সব্বাই-ই পিআইবি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পিআইবি কিংবা ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের গৃহীত নীতিমালা মেনেই মূলত: পত্রিকাটির সংবাদ উপস্থাপন এবং মেকআপ দেয়া হয়ে থাকে। অবশ্য স্থানীয় জনগণের পুঞ্জিভূত সমস্যাবলী ও অসুবিধাগুলোকে সবসময়ই আমোদ প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তাই পাঠকমহলে এর সমাদর ও জনপ্রিয়তা এতদিন পরেও কমেনি। এশিয়ার সফল কমিউনিটি নিউজপেপার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পিছনে যে ব্যক্তিত্বটির দূরদর্শিতা, নিরলস প্রচেষ্টা, শ্রম ও মেধা প্রধানত সক্রিয় ছিলো তিনি আর কেউ নন প্রত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রসঙ্গের অবতারণা করছি এখন। কুমিল্লায় তিনি পরিচিত ছিলেন মূলত একজন খেলোয়াড় হিসেবে। এমন কোন খেলা নেই যা তিনি জানতেননা। তাঁর আস্তানাই ছিলো খেলার মাঠ, বিশেষ করে কুমিল্লা স্টেডিয়াম, বর্তমানে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম। একসঙ্গে ক্রীড়া বিষয়ক লেখালেখিও করতেন তাঁর যুবা বয়েস থেকে ।
কোন কীর্তিমান সুধীজন তাঁর মাথায় ক্রীড়া বিষয়ক একটি সাপ্তাহিক প্রকাশের চিন্তাধারা ঢুকিয়েছিলেন এই মুহূর্তে বলতে না পারলেও, তা যে কুমিল্লাবাসীর জন্যে কল্যাণকর হয়েছিলো পরবর্তীতে বলাই বাহুল্য। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি ০৫ মে, ১৯৫৫ সালে ক্রীড়া বিষয়ক সাপ্তাহিক আমোদ প্রকাশ করেন। তারপরের সবটাই ইতিহাস হয়ে রয়েছে এ অঞ্চলের জনগণের কাছে ।
আমার দেখা বিরল কয়জন ব্যক্তিত্বের মধ্যে রাব্বী ভাইকে একজন নিপাট ভদ্রলোক হিসেবেই চিহ্নিত করবো। কি পোষাক-পরিচ্ছদে, বচনে, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে এবং সব বয়েসী লোকজনদের সঙ্গে তাঁর উষ্ণ, অনুপম সম্পর্ক ও সদ্ভাবের জন্যে। এই লম্বা ছিপছিপে গড়নের মানুষটা তাঁর পছন্দের সাদা প্যান্ট বা ট্রাউজার এবং সাদা শার্ট পরে কাঁধে বক্স ক্যামেরা (ইয়াশিকা ম্যাট বা ইয়াশিকা-ডি) ঝুলিয়ে সাইকেলে চড়ে সংবাদের সন্ধানে শহরে তাঁর পুরোনো চৌধুরীপাড়ার বাসা থেকে বের হতেন হররোজ। তাঁকে দেখেছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। পরবর্র্তীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পিছনে তা বেশ কাজ করেছিলো, স্বীকার করছি।
এখন আসছি আমোদ-এর সঙ্গে আমার সম্পৃৃক্ততার প্রসঙ্গে। ১৯৮৩ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিশ^কাপ ক্রিকেটের ওপর একটা বিশ্লেষণাত্মক কার্টেন রেইজার বা টুর্নামেন্টের পর্দাÑউন্মোচক লেখা দিয়ে এই লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছিলো। ঐতিহ্যবাহী আমোদ-এর সঙ্গে। পরপর দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটের পরাক্রমশালী দেশ ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারত চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলো। সেসময় আমোদ-এর বার্তা ও ক্রীড়া বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন বরেণ্য সাংবাদিক বর্তমানে সাপ্তাহিক অভিবাদন পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত বাবুল। তিনি আমায় অনুরোধ করেছিলেন তৃতীয় ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট কাপের ওপর কার্টেন রেইজারটা লিখবার জন্য। সেসময় আমি দ্য ডেইলি নিউ নেশান পত্রিকার কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি হিসেবে বছর দুয়েক হলো কাজ করছি। ছোটভাই বাবুল ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আর রাব্বী ভাই সভাপতি। আমি ও সিনিয়ার সাংবাদিক অধ্যাপক আলী হোসেন চৌধুরী সহ-সভাপতি। যদ্দুর মনে পড়ে সেসময় থেকেই লিখছি পত্রিকাটিতে। সময়ে অসময়ে।
এর আগে অবশ্য শ্রদ্ধেয় রাব্বী ভাইকে নানা অনুষ্ঠানে দেখেছি। সভা সমাবেশে। দেখেছি সংবাদ সংগ্রহ করতে, ছবি তুলতে এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিক বা গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সরকারি আমলাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে। তাছাড়া, রাব্বী ভাইয়ের পছন্দের জায়গা ক্রীড়া ক্ষেত্রে, কখনো সিডিএসএ (কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস এ্যাসোসিয়েশান) আয়োজিত ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিনটন ও অন্যান্য টুর্নামেন্টে স্থানীয় কুমিল্লা স্টেডিয়ামে, পুলিশ লাইনে, স্টেশন ক্লাব বা কুমিল্লা ক্লাবে অথবা অন্য কোন মাঠে। তবে, সব জায়গায়ই এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটির সঙ্গে একটা সম্মানসূচক দূরত্ব পালন করেছি আজীবন। অবশ্যই ১৯৮১ সালে তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিকতায় ঢুকে যখন পড়ি সেসময় থেকে পারস্পরিক এই সম্মানসূচক সম্পর্ক আরো দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ হয়েছে । রাব্বী ভাই ২৮ নভেম্বর, ১৯৯৪ সালে পরপারে যাত্রার দিনটিতে আমি কুমিল্লায় ছিলামনা। ঢাকায় অপর একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকার (অধুনালুপ্ত দ্য ডেইলি মর্ণিং সান) কাজে প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিলাম। কিন্তু এ দু:সংবাদটা বোধকরি সাংবাদিক তপন সেনগুপ্তের কাছ থেকে শুনে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
বলা হয়ে থাকে আমোদ হলো একটি পারিবারিক পত্রিকা। এই অঞ্চলে কবি, সাহিত্যিক, লেখক সর্বোপরি সাংবাদিক গড়বার একটি প্রতিষ্ঠান। কেননা, রাব্বী ভাই তাঁর তিন কন্যা এবং একমাত্র ছেলে বাকীন রাব্বী সবাইকেই শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষায় (একাডেমিক) শিক্ষিত করেই তুলেননি পত্রিকাটির সব বিভাগে, সংবাদ সংগ্রহ থেকে সম্পাদনা, ফটোগ্রাফী, কমপিউটার ও হ্যান্ড কম্পোজ, প্যাকেজিং, বিলি-ব্যবস্থা ইত্যাদি পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন হাতে-কলমে। তারাও পত্রিকাটির সার্বিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওতোপ্রোতোভাবে। তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার রাব্বী পত্রিকাটির সম্পাদনা এবং সাময়িকী বিভাগ সামলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। সফলভাবে সংসার সামলাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বি.এ. এবং বি.এড ডিগ্রিও অর্জন করেন পত্রিকাটিতে কাজ করবার ফাঁকে ফাঁকে । তরুণ নব্য কবি, সাহিত্যিক, লেখক সর্বোপরি সাংবাদিকরা আমোদ-এ তাদের লেখা প্রথম ছাপা হয়েছে দেখে অনুপ্রাণিত হতো এবং আত্মসন্তুষ্টি লাভ করতো।
মনে পড়ছে, খুব সম্ভব দেশ স্বাধীন হবার পর কুমিল্লায় প্রেস শ্রমিকরা হঠাৎ করেই ওয়ায়িল্ড ক্যাট স্ট্রাইকে (আকস্মিক ধর্মঘট) যায় । তাদের বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুবিধাদি প্রদানের দাবিতে। আলাপ-আলোচনার পথ হঠাৎ করেই রুদ্ধ করে দিয়ে। আমোদ তখন টাইপ কম্পোজ করে লেটার প্রেস বা রাব্বী ভাই-এর মালিকানাধীন ফø্যাটবেড প্রেস থেকে ছাপা হতো। আমি তখন সিংহ প্রেস চালাই । বড়ই সমস্যায় পড়ে গিয়েছি । এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থার মধ্যেও আমোদ ঠিকই যথাসময়ে প্রকাশিত হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছায়। আমরা বিস্মিত হই। কেননা আমোদ পরিবারের সদস্য সব্বাই-ই টাইপ কম্পোজ করা শিখে নিয়েছিলেন। তারাই কম্পোজ করে নির্দিষ্ট দিনে পত্রিকাটি প্রকাশে সমর্থ হন ।
১৯৯৪ সালে রাব্বী ভাই-এর মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিনী শামসুন্নাহার রাব্বী পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। রাব্বী ভাই তখন পরিচালনা সম্পাদক ও তাদের একমাত্র পুত্র বাকীন রাব্বী ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পরিবারটি আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে গিয়েছে। শামসুন্নাহার রাব্বী ১৯৮৫ সাল থেকে পত্রিকাটির সম্পাদনা করেছেন। এর আগে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি মাসিক ময়নামতি নামে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন।
২০১৬ সালে আমেরিকায় শামসুন্নাহার রাব্বী গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকীন রাব্বী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ২০১৮ সালে বাকীন রাব্বী পুরোপুরিভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তখন শামসুন্নাহার রাব্বীকে উপদেষ্টা সম্পাদকের পদে আসীন করা হয়। সে বছর থেকে এখনো বাকীন রাব্বী পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বছরের বেশ কিছুটা সময় দেশে অবস্থান করেন। ২৫ জুন, ২০২১ সনে বিদুষী ও মহীয়সী শামসুন্নাহার রাব্বী পরলোকগমন করেন।
একটা হতাশার কথা নিবেদন করে নিবন্ধটির ইতি টানছি। আমাদের প্রিয় সাপ্তাহিক আমোদ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করলেও স্থানীয়ভাবে বা জাতীয় পর্যায়ে পত্রিকাটিকে বা এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদককে আজ পর্যন্ত বিপুল অবদান ও বিরল কৃতিত্বের জন্য কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এটা অত্যন্ত পরিতাপের, লজ্জার এবং আত্মপ্রবঞ্চনাকর বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করছি। একটা মূল্যবান শাশ^ত প্রবচন হলো, যে জাতি তার কৃতি সন্তানকে বা প্রতিষ্ঠানকে সম্মান দিতে জানেনা তার উন্নতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্যাহত হয়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব
শান্তি কুটির, তালপুকুরপাড়, কুমিল্লা।
মোবাইল: ০১৭৩১-৫১২৭২২