আমোদ সত্তরে পা দিয়েছে

 

।।ডা. আবু নাঈম ।।
আমোদ দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক এতটুকু অনেকের জানা। বিশেষ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্খ্যংায় তাই অ লেখকের লেখবার সুযোগ হয়েছে।
লিখতে গেলে মস্তিষ্ক, চক্ষু, হাত, কালির পর সবচে দরকারী বস্তু কাগজ। এদিকে অনেকেই কাগজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। কাগজ অদূর ভবিষ্যতে আর নাকি থাকবেই না শুধু টয়লেট পেপার ছাড়া। কাগজের স্থান দখল করবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস। কিন্তু পরিস্খ্যংান বলছে কাগজের চাহিদা ১৯৫০ এর পর ৭% বেড়েছে এসময়ে। তাই খুব দ্রুতই বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকার আবেদন ফুরোচ্ছেনা এটুকু নিশ্চিত। মানুষ আধুনিকতা চায়, আপডেট থাকতে চায়। আলবেয়ার কাম্যু একবার বলেছিলেন,আধুনিক মানুষ কারা এ প্রশ্নের জবাবে, “যে মানুষ রমণ করে আর পত্রিকা পড়ে সেই আধুনিক মানুষ।”

মিশরীয় সভ্যতার দান কাগজ বা নথির বা পুস্তকের। নীল নদের তীরে নলখাগড়া জাতীয় গাছ পাওয়া যেত। সেই গাছ কেটে প্রাপ্ত খোলকে পাথর চাপা দিয়ে রোদে শুকানো হতো। খোলগুলো শুকিয়ে গেলে পাথরের চাপে সোজা হয়ে লেখার উপযোগী হতো। পরবর্তীতে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রোল আকারে সংরক্ষণ করা হতো । প্যাপিরাসের এক একটি রোল লম্বায় ১০ – ২০ ফুটের মতো হতো। এভাবে তৈরি প্রাচীন লেখার উপযোগী মাধ্যমকে প্যাপিরাস বলা হয়।
বর্ণমালার সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিশরীয়দের যেমন বিশেষ অবদান ছিল, তেমনি তারা আবিষ্কার করেছিলেন লেখার উপযোগী এই চমৎকার উপাদানটি।
তবে লেখালেখির জন্য মন্ড থেকে উদ্ভব ঘটে পাতলা কাগজের ২০০ খ্রীস্টাব্দে চীনের হান সাম্রাজ্যে চান লুই এর হাত ধরে। আধুনিক কলের কাগজ ও বিভিন্ন উদ্ভিদের মন্ড থেকেই প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও হাতে বানানো কাগজ কিংবা কালি অপসারণ করেও কাগজ বানানো সম্ভব।
কাগজ বানানোর উপাদান পাল্পউড আবাদ হচ্ছে আবার মূল বনেই। সেসব বন উজাড় হচ্ছে। তাই পরিবশবাদীরা বন ধ্বংসের বিপক্ষে। বরং পুরনো কাগজ রিসাইকেল করে নতুন কাগজ বানানোর পক্ষে। আমিও সে দলের একজন। পক্ষে বিপক্ষে নানা মত থাকবেই। যেমন এই প্রখর দাবদাহে গাছ লাগানো -না লাগানো নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ নিতে যেয়ে তর্ক থেকে যুদ্ধ লেগে যাবার উপক্রম। হটাৎ দাবদাহ এসে জানিয়ে দিচ্ছে আমাদেরকে গাছের প্রয়োজনীয়তার কথা ।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় জুন জুলাই মাস গাছ লাগাবার মওসুম। বৈশাখের খাঁ খাঁ রোদ্রময় শুকনো মাটিতে গাছ লাগিয়ে ক’জন বাঁচাতে পারবেন?
গাছ শুধু লাগিয়ে ছবি তুলে আর সেসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেই কাজ সমাপ্ত হয়েছে এমন লোকের স্খ্যংাই এখন বরং দেখতে পাচ্ছি বেশি। গাছ লাগাবার আগে স্থান পরিচর্যাকারী ও গাছের জাত নির্বাচন জরুরি।। যেমন ভিনদেশী গাছ কৃষ্ণচূড়া হরহামেশাই এদেশের সড়কের পাশে লাগানো হয়। অথচ এই গাছের ডালপালা খুবই নরম। সেসব সামান্য ঝড়ে ভেংগে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এই গাছটি তাই সড়কের পাশে না লাগিয়ে খোলা মাঠ যেখানে লোক সমাগম কম থাকে সচরাচর কিংবা ঝড়ের সময় যার পাশে লোক থাকবেন এমন স্থানে লাগানো উচিত।
ভিনদেশী বিভিন্ন গাছ মেহগনি, সেগুন, আকাশমণি, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিল, রেইনট্রি, শিশু, লম্বু গাছ এমন ভাবে আমাদের দেশে আত্তীকরণ হয়েছে বুঝবার উপায় নেই এরা দেশী গাছ নয়। বরং বিদেশি, আগ্রাসী এবং আমাদের দেশের পরিবেশের জন্য হুমকীস্বরুপ।
বিদেশি এসব গাছে খেয়াল করে দেখবেন পাখিও কম বসে এবং বাসা গড়েনা। পাখিদের নিজস্ব জিওগ্রাফিক এলাকার গাছ পছন্দ।
দেশি ফল গাছ আম, ফলসা, লুকলুকি, কাঁঠাল, ডেওয়া, তেঁতুল, দেশী গাবফল গাছের তালিকায় রাখা উচিৎ। ফুল গাছের মধ্যে সোনালু, জারুল, অশোক, শিমুল, পলাশ, ছাতিম, উদাল, কুরচি, শিউলি, বকুল। ঔষধী গাছ হিসেবে তালিকায় রাখা যেতে পারে হরিতকী, নিম, আমলকী, বহেরা ইত্যাদি।
গাছের তালিকার পাশাপাশি কাজের তালিকাও করা প্রয়োজন আমাদের সবার। কাজের তালিকায় গাছ এবং পরিবেশ ধ্বংস করে এমন সব কাজ নিষিদ্ধ তালিকায় রাখাই হবে একজন প্রকৃত মানুষের কাজ। পাশাপাশি পত্রিকা, সংবাদমাধ্যম, মিডিয়ার কাজ অবশ্যই বেশি বেশি লেখা , সংবাদ প্রচার করা এ বিষয়ে।
আমাদের প্রিন্ট ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার অনেক সাংবাদিকেরা প্রকৃতির জন্য বিনা লাভে খেটে যাচ্ছেন এমন মানুষদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে আগ্রহ পান না। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন অনেক ভলান্টিয়ার। গাছ আর পরিবেশ নিয়ে যাদের কাজ তাদের বেশিরভাগ লোকই এদেশে আলাদাভাবে কোন সমাদর পান না। পুরষ্কার বলতে কিছু বস্তুর প্রচলন আছে বটে। সেসব বরাদ্দ থাকে ভালো লবিং আছে এমন লোকদের জন্য। দেখা যাবে কাজ করেছেন হয়ত এক গ্লাস পরিমাণ, নিউজ বা মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে পুকুর পরিমাণ আর লবিং করেছেন সাগর পরিমাণ। খেয়াল করলে দেখবেন, এই শ্রেণির পরিবেশকর্মীদের মূল লক্ষ্যই পুরষ্কার পাওয়া। এদের ভিড়ে প্রকৃত অর্থে আড়ালে অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন প্রকৃত পরিবেশকর্মীরা।
অন্ধকারের উপর আলো। আলো আছে আর ভালো বলেই এখনো সব স্বার্থের উপর থেকেও অনেকে কাজ করে যান প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে। সেসব প্রকৃতিবন্ধুদের খুঁজে বার করার দায়িত্বটাও সংবাদকর্মী আর পত্রিকার উপর বর্তায়।
পাহাড় কেটে ফেলে, নদীর মাটি বিক্রি করে, বনভূমি উজাড় করে, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ ফেলে নদী দূষণ, খাল বিল ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, যত্র তত্র অনুমতি ছাড়া কারখানা স্থাপন, বন্যপ্রানী হত্যা করে, শব্দ দূষণ করে কেউ যেন রেহাই না পায়। সংবাদপত্র, ইইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় এসব খবরের বহুল প্রচার প্রসার চাই। ক্ষমতাসীনদের সু নজরে থাকবার জন্য কোন সাংবাদিক যেনো নিজ মহান পেশাকে জলাঞ্জলি না দেন। পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংসের হোতা যেই হন না কেন তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের যাবতীয় শিক্ষার সূতিকাগার হলো পরিবার। আর পরিবারের সবাইকে সমভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে সংবাদপত্র।
আমোদ কী পারবেনা অন্তত সংবাদ দিয়ে আমাদের পরিবারগুলোকে প্রভাবিত করতে?
অক্ষররাজিকে জগতের সকল প্রাণের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, সহমর্মিতা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে? সংবাদ দিয়ে আমাদের ধ্যান চিন্তাকে উন্নত করতে? অন্তত প্রিয় পত্রিকা আমোদ এর কাছে ভালো সব কিছুর প্রত্যাশা এবং সেই সাথে দেখবার অপেক্ষা। জগতের সকল প্রাণের ভালো হোক।

লেখক:চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী।