আশা ভঙ্গের বাস্তবতা ও প্রত্যাশা
বাংলাদেশের ৫৩তম বিজয় দিবসঃ
।। আলমগীর মোহাম্মদ ।।
১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ বাংলাদেশের ৫৩তম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি পায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ দেন ৩০ লক্ষ বঙ্গ সন্তান। লুট হয় এদেশের অধিকাংশ সম্পদ। ধবংস করা হয় অবকাঠামো। বিজয়ের দুই দিন আগে সবচেয়ে বড় ক্ষতি সাধিত হয় আমাদের। ১৪ ডিসেম্বর এদেশের গুণী শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। অপরিসীম ত্যাগ ও অপূরণীয় ক্ষতি স্বীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ মুখ দেখে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের। দেখা দেয় নতুন ভোর। দেশের মানুষ মুখ দেখে নতুন সূর্যের। আমরা মাথা উঁচু করে বলতে শিখি ‘ একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময়/ তুমি আমার অহংকার।‘
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার এই তিন শ্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ডাক দেয়। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় হলো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতি হিসেবে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে বারবার ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু, এই দীর্ঘ ৫৩ বছরে আমরা দেশে একটি সুসংহত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছি পুরোপুরিভাবে। ফলে সমাজে সাম্যের গান গাওয়া আমাদের জন্য সুদূরপরাহত রয়ে গেছে।
ফরাসী বিপ্লবের শ্লোগান ছিলো স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। আমাদেরও শ্লোগান ছিলো সাম্য প্রতিষ্ঠার। কিন্তু, সাম্য প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড়ো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় কলুষিত রাজনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন সংগঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। সে নির্বাচনই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতা বাংলাদেশকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে।
নির্বাচন সম্পর্কে সবচেয়ে মজার কিন্তু বাস্তবিক মন্তব্য করেছেন আমেরিকান দার্শনিক ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ লেখক হেনরি ডেভিড থরো। তিনি বলেছেন, সকল প্রকার ভোট আসলে এক ধরণের জুয়ো। তবুও আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় নির্বাচনই একমাত্র মাধ্যম যার ফলে জন আকাঙ্খার সর্বোচ্চ প্রতিফলন হয়। কিন্তু, সেই নির্বাচন ব্যবস্থায় ত্রুটির ফলে বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। হয়নি কাক্সিক্ষত উন্নয়ন। নিকট অতীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমরা যোজন যোজন পিছিয়ে আছি । মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
সুশাসনের অভাবে একটি দেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজব্যবস্থা। ফলে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কাল হয়ে দাড়িয়েছে। দুর্নীতি, ন্যায়নীতিহীনতা, লুটরাজ ও বৈষম্যের অস্তিত্ব ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব সেক্টরে। অথচ পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো একটি ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনের অভিপ্রায়।
দলদাসত্ব, দুর্নীতি , সামাজিক অনাচার এবং সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদে ৫৩তম বিজয়ের বছর এদেশের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। ৫২, ৬৯, ৭১ এবং ৯০ এর গণ আন্দোলনের দীক্ষা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে টানা পনেরো বছরের স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করেও ছাত্রজনতার দৃঢ় মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। দুই সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়েব এদেশের ছাত্রজনতা অবশেষে গত ৫অগাস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। ৩৬ দিনের লাগাতার আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অধিকাংশ সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বিচারহীনতা, গণতন্ত্রহীনতা এবং ভোট লুটের মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হয় এক অরাজক পরিস্থিতি।
সুশাসনের অভাবে একটি দেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজব্যবস্থা। ফলে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি, ন্যায়নীতিহীনতা, লুটরাজ ও বৈষম্যের অস্তিত্ব ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো একটি ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনের অভিপ্রায়। দলদাসত্ব, দুর্নীতি , সামাজিক অনাচার এবং সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদে ৫৩তম বিজয়ের বছর এদেশের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। ৫২, ৬৯, ৭১ এবং ৯০ এর গণ আন্দোলনের দীক্ষা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে টানা পনেরো বছরের স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করেও ছাত্রজনতার দৃঢ় মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। শতাধিক প্রাণের বিনিময়েব এদেশের ছাত্রজনতা অবশেষে গত ৫অগাস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়।
গত দুই দশকে ন্যায় বিচারহীনতা, গণতন্ত্রহীনতা এবং ভোট লুটের মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হয় এক অরাজক পরিস্থিতি। আমাদের বিবেকের আতুরড়ঘর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠে স্বজনপ্রীতি ও অন্ধ দলদাসত্বের বলি। যা বর্ণনা করা যায় খলিল জিবরানের একটি কবিতার উদ্বৃতি দিয়ে। “সেই জাতির জন্য করুণা” কবিতায় জিবরান বলেন, সেই জাতির জন্য করুণা যাদের মত অনেক কিন্তু নেই কোন ধর্ম।/
“সেই জাতির জন্য করুণা যারা কাপড় পরিধান করে কিন্তু নিজেরা তৈরি করে না,এবং অন্যের উৎপাদিত খাবার খেয়ে বাঁচে।/ সেই জাতির জন্য করুণা যারা গুন্ডাকে বীরের মর্যাদা দেয় এবং চাকচিক্যময়তাকে মহান মনে করে।
সেই জাতির জন্য করুণা যারা আবেগকে তাদের স্বপ্নে ঘৃণা করে,কিন্তু স্বপ্নের জাগরণে হার মানে।
সেই জাতির জন্য করুণা যারা মুখ খোলে না দুর্দিনে মৌনব্রত পালন করে এবং
নিজেদের পতনে গর্ব করে,এবং প্রতিবাদ না করে গা বাঁচিয়ে চলে
এমনকি যখন তাদের গদ্দান তরবারি ও ফাঁসিকাঠের মাঝে আটকা পড়ে।
সেই জাতির জন্য করুণা যাদের বিবৃতি ধূর্তামি,
যাদের দার্শনিক একজন বাজিকর,এবং যাদের শিল্প জোড়াতালি ও অনুকরণ নির্ভর।
সেই জাতির জন্য করুণা যারা নতুন শাসককে তুরি বাজিয়ে স্বাগত জানায়,
এবং বিদায়ে জানায় ধিক্কার,শুধু অপরজনকে তুরি বাজিয়ে পুনরায় স্বাগত জানাতে।
সেই জাতির জন্য করুণা যাদের বুদ্ধিজীবীরা বছরের পর বছর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে
এবং যাদের বলবানেরা এখনো দোলনরত। সেই জাতির জন্য করুণা যারা অন্তর্কোন্দলে জড়িত,
প্রত্যেক দল নিজেদেরকে জাতি মনে করে।“
জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব আমাদেরকে নতুন করে শিখিয়েছে অন্যায় সেটা যার দ্বারাই সংগঠিত হোক না কেনো তার প্রতিরোধ একদিন করতে হবেই। গণ আন্দোলন ছাড়া জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয় না। জনদুর্ভোগ থেকে সহসা মেলে না মুক্তি। আমাদের মধবিত্ত শ্রেণীর ‘সুবিধাবাদী চরিত্র’ দীর্ঘদিন ভোগালেও এখন সময় এসেছে নিজেদের চোখ খোলার। সময় এসেছে এই উপলদ্ধির ‘রাষ্ট্রের একজন নাগরিককেও যদি অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা হয়,কারো সাথে জুলুম করা হয়, তাহলে বিবেকবান মানুষের জন্য পুরো দেশ একটা কারাগারে পরিণত হয়‘ যুবশক্তি একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী শক্তির পতন ঘটিয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছে বুড়োরা যেখানে ফুরিয়ে যান, সেখানেই নতুনের জয়গান শুরু হয়। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমরা এই দেশকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য করেও তোলার জন্য কী করছি, কী করিনি এবং আমাদের কী কী করা উচিত।
শত শত ছাত্রজনতার প্রাণের বিনিময়ে সফল হওয়া জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা বড় শিক্ষা। আমাদের শপথ নিতে হবে আমরা নাগরিক হিসেবে নিজেদের অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়ে সচেতন থাকব। অন্যায়ের মুখে চুপ করে থাকব না। নিজেও কোনো অন্যায় কাজে জড়াব না। সমাজে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। স্বাধীন- সার্বভৌম এই মাতৃভূমিতে যাতে অপরাজনীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে আমাদের সবার উচিত হবে সচেষ্ট থাকা।
লেখক: অনুবাদক। বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লার ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হল প্রভোস্ট।