ইউসুফ ও রেজু মামাদের গল্প

আবদুল্লাহ আল মারুফ।।
শৈশবে আমাদের নিয়মিত চুল কাটার একটা স্টাইল ছিল। শুকু দাদু এসে আমাদের দুই ভাইসহ বাড়ির ছেলেদের আর্মি কাটিংয়ের চুল কেটে যেতেন। পিড়িতে বা সুপারির খোলে বসে চুল কাটা শেষ। তাতেও থাকতো লম্বা লাইন। যে যা পারতো তাই দিতো। কেউ কেউ চাল, ডাল, হলুদ-মরিচও দিয়ে দিতেন। আমরা দুই ভাই এই স্টাইলে চুল কাটতাম মূলত রেজু মামার ভয়ে। এখনও আর্মি কাটিংয়ে চলছে। ইউসুফ ও রেজু মামা আমাদের ছোটবেলা থেকে এভাবেই গাইড করেছে। রেজু মামার মূলত নাম রেজাউল। ছোটবেলা থেকে শুনেই রেজু মামা বলে ডাকতাম।
রেজু মামা নেই। গেলো রমজানেও মামার সাথে ইফতার করেছি। আমি পথে থাকা অবস্থায় আজান দিয়েছে। উনি ইফতার করেননি। ভাগিনা আসলে করবেন এই ভেবে। ঈদ গেলো। আবার ঈদ এলো। মামা নেই। বাড়ির অদূরে রাস্তার পাশের কবরে শুয়ে আছেন। ওহ কথায় কথায় রেজু মামার বাকি পরিচিয় দেয়া হয়নি। উনি আমাদের বংশের কিংবা রক্তের আত্মীয় নয়। কিন্তু হৃদয়ের আত্মীয়। আমাদের এলাকার জামাই তাছাড়া উনি ছিলেন গ্রামের পল্লী চিকিৎসক। কেউ অসুস্থ হয়েছে আর মামা যাননি এমন ইতিহাস নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে নেই। এলাকার মানুষের পরামর্শদাতা, সমস্যার সমাধানকারী ও হাসিমুখে খোলা হৃদয়ের মানুষ ছিলেন।
উনার বাবার ভিটা থেকে আমাদের গ্রামের দূরত্ব কয়েক মাইল। এত দূরে এসেও তিনি মসজিদের ক্যাশিয়ার, বাজার কমিটি, মানুষের ঋণের জামানতদার ও কয়েকবার অনেকের বড় সংখ্যার লেনদেনের জামানতদার হিসেবেও দেখেছি। অবাক বিষয় এত জনসম্পৃক্ততার পরেও উনার কোন দুর্নাম ছিল না।
আমরা যাদের দেখে বড় হয়েছি। কথা বলতে শিখেছি, মানুষকে সম্মান করতে ও স্নেহ করতে শিখেছি তাদের মধ্যে একজন শাহ আলম মামা। গ্রামের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক তিনি। উনার সঙ্গে রেজুমামার খাতির ছিল মানিকজোড়ের মতো। উনারাই বলতেন রেজু মামা কেমন মানুষ ছিলেন।
গেলো বছরের ঈদ মামার সঙ্গে গ্রামের মানুষেরও ভালো কাটেনি। আমি বিশ্বাসই করিনি মামা এই ঈদে থাকবেন না। মামা ছাড়া এটা দ্বিতীয় ঈদ। গ্রামে ঈদ এসেছে কিন্তু মামার একমাত্র ছেলে সুমন আর তিন মেয়ের ঈদ আসেনি। এই রমজানেও গিয়েছি মামার ঘরে। ইফতার করেছি। সবাই আছে। কেউ একজন নেই। পুরো ঘরে শূন্যতা বুঝতে খুব বেশি দেরি হয়নি। আমার চোখের আকাশ ভেঙে আসছিল লোনা পানি। ইফতার করে নামাজ পড়ে বেশি দেরির সাধ্য ছিল না। জোর করে খাওয়ানো কয়েকলোকমা ভাতও যেন পাথর লেগেছে। চলে এলাম বাড়ি। কান্না চেপে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা ভাবিয়েছে রেজু মামা আসলেই আমাদের এত আপন কেন হলেন?
আমার মেজু ভাই ছোট বেলা থেকেই শ্বাসকষ্টের রোগী। ছোট বেলায় তার শ্বাসের শব্দ নাকি বাড়ির কয়েকশ’ হাত দূর থেকেও শোনা যেতো। তাকে হাসপাতালে নেয়া, দৌড়াদৌড়ি করা এর সবই রেজু মামা করেছেন। সঙ্গে ছিলেন ইউসুফ মামা। আমাদের নতুন ঘরের কাজ, কাজের পরিকল্পনা, টাকা সবই উনার বুদ্ধি। আমাদের অসুস্থ, আম্মার তিনটা অপারেশন, নানুর মৃত্যু পথ থেকে ফিরে আসা, খালামনির বিয়ে, ইউসুফ মামার বিয়ে, আমাদের পড়াশোনা, ইউসুফ মামার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা এসবের নেপথ্যে রেজু মামার নাম। তবে এখনও যিনি পথ হারালে ডেকে দেন তিনি শাহ আলম মামা। যারা আমাদের জন্য পিঠাপিঠি। আর চালকের আসনে আমাদের এই যাত্রা নিরাপদ করে যাচ্ছেন ইউসুফ মামা।
আরেক গল্প আছে রমজান নানাকে নিয়ে। রমজান নানা আমার দাদুর বংশের। দূরের আবার কাছের দুইভাবেই আত্মীয় তিনি। দাদু একবার বলেছেন আমাদের পাঁচ পুরুষ আগে নাকি রমজান নানাদের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছি। আমরা এখনও তা ধরে রেখেছি। নানার সঙ্গে সখ্যতার মূলে ছিল আম্মা আর আব্বা। উনারা সম্পর্কের যতœ নেন। উনারাই বলেছেন নানা আমাদের কাছের মানুষ। ছোট বেলা থেকে নানার বড় ছেলে কাইয়ুম পরে কাউসার, কায়েস ও রাসেলের স্নেহ আমাদের দুই ভাইকে আগলে রেখেছে। ২০২০ সালের রমজানের ঈদের ঘটনা। নামাজ শেষে ধরে নিলেন বাড়ি। বললেন তোর নানি বসে আছে তোর জন্য। গিয়ে দেখি এলাহি আয়োজন। ঘরের কবুতর, মুরগি সব জবেহ করে রেঁধেছেন। দাওয়াতি মেহমান শুধুই আমি। সম্পর্কের উদাহরণ এঘটনাই। এরপর গাছের ডাব, নারকেল, আম, জাম কোন কিছু থেকেই বঞ্চিত হতাম না।
মজা ঘটনা ঘটে এতেকাফ করাকালীন। নানার হাত কাঁপার অসুখ ছিল। তাই চিনি জাতীয় খাবার নিষেধ। নানু তাই টক আম নানার জন্য কেটে বাটি করে দিতেন। একদিন পর নানু জানলেন আমিও এতেকাফে আছি নানার সঙ্গে। পরদিন নানু টক আমের সাথে আলাদা বাটিতে মিষ্টি আম দিলেন। যে খাবার দিতে এলেন তাকে বলে দিলেন এটা কার জন্য। নানা ভাই আমার মজার মানুষ। মিষ্টি আমের বাটি লুকিয়ে রেখে বললেন দেখ নাতি তোর নানি তোর জন্য আজ কি টক আম গুলা দিলো। পরে অবশ্য নিজেই বের করে দিলেন মিষ্টি আম। আমাদের সম্পর্কও এমন ছিল।
নানাও চলে গেছেন। এইতো কদিন আগে। মৃত্যুর মাসখানেক আগে লোক মারফতে আম্মার কাছে খবর গেলো। আমি যেন দেখা করি। সকালে খবর শুনেই বিকেলে বাড়ি। সন্ধ্যায় নানার সঙ্গে দেখা। তখনও বসতে পারেন। কথাও বলতে পারেন। ঝলমলে চেহারা। ঘরের বাইরে থেকে সালাম শুনেই অট্টহাসিতে বললেন আমার ভাই আইছে দরজা খোলো। বুকের একপাশে নিয়ে বসালেন। হাসতে হাসতে বললেন আমি জানতাম আমনে আইবেন। আমি আমার নাতিরে চিনি। পরে দাদির কথা বললেন। বাবা চাচাদের সংগ্রাম ও নিজের কথাও বললেন। নানু বসে আছেন পাশে। নানুকে বললেন তুমিও সাক্ষী থাকো কি কি বলছি। এককথা দুই কথা নানার কতকথা। আসার আগে বলছিলেন, এটা তোমার সাথে শেষ দেখা। সব কথা মনে রাইখো। নানু এই কথা নিয়ে মজা করলেন। কিন্তু নানুর হাসির আড়ালেও ভয়ের আভা ছিল। যা সত্যি হলো। নানা এমন মানুষ ছিলেন। গ্রামের মসজিদের আজান দেয়া, মুসল্লিদের সঙ্গে ইকামাত দিয়ে নামাজ পড়া, গ্রামের পুরুষরা মারা গেলে ধোয়া ও কাফনের কাপড় পরিয়ে দেয়া, কবর খোলতে সহযোগিতা নানার নিয়মিত কাজ ছিল। ধর্মভীরু নানা পরিবারে রেখে গেছেন দুই রতœ।
এই ঈদে নানাকে দেখবো না। ভাবতেই গলা ভার হয়ে আসে। চোখে লোনাপানি ভিড় করে। কারণ প্রিয়জনদের একজন ছিলেন রমজান নানা।
এছাড়াও স্মৃতিতে আছেন শিপন কাকার মা। দাদুর মৃত্যুর পর উনার আঁচলে দাদুর গন্ধ লাগতো। বাড়ি গেছি অথচ দাদুর সাথে দেখা হয়নি এমন ইতিহাস নেই। নিজ ইচ্ছায় আসতেন। কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে যেতো আমাদের। বড় জেঠার কথাও মনে পড়ে। তবে উনার কথা মনে হয় ভয় হয়। বাবারা তিন ভাই। জেঠা মারা যাওয়ার পর কেটেছে কয়েকটা ঈদ। সব ঈদেই জেঠাতো ভাই ও বোনদের চোখের কোটরে পানি দেখা ভীষণ বেদনার।

লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি,বাংলা ট্রিবিউন।