স্মৃতির পাতায় শৈশবের ঈদ

 

হাসিবুল ইসলাম সজিব।।
বয়সটা কেবল পঁচিশ। মধ্যবৃত্তি পরিবারের সন্তান হওয়ায় অল্প বয়সে পাড়ি দিতে হয়েছে ইট পাথরের যান্ত্রিক শহরে। যেখানে রয়েছে চারদিকে প্রচুর ধূলিকণা, গাড়ির গ্যানগ্যান,মানুষের প্যানপ্যান, মানুষ যেন যান্ত্রিক রোবটে পরিণত হয়েছে। ভোর হলে বাসা হতে কর্মস্থলে যা-ও, সন্ধ্যা হলে বাসা ফিরে আসা। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। সকাল হলে পুনরায় নিয়মে ছুটে চলা ছাড়া আর কিছু নেই তাদের জীবনে। গ্রামীণ জনপদের মত নেই তাদের জীবনে খেলাধুলা,হই হুল্লোড়, বিকেল হলে সবাই মিলে একসাথে বসে আড্ডা জমানোসহ আরো কত কি।
প্রতিটি মানুষের আনন্দপূর্ণ স্মরণীয় স্মৃতিমাত্রই কিশোরকাল। কিশোরকালের নির্মল আনন্দের সঙ্গে জীবনের অপর কোনো অংশের আনন্দ মেলানো যায় না।
প্রথম রোজা থেকে রোজার মাসজুড়ে আমাদের সব ভাই-বোনের মধ্যে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা ছিল। কে-কার চেয়ে অধিক রোজা রাখতে পেরেছে, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক। রোজায় সবারই স্কুল বন্ধ থাকায় মাসজুড়ে আনন্দ-ফুর্তিতে সময়গুলো কেটেছিল। রোজার দিন সকাল বেলায় ক্রিকেট, কানামাছি, লুডু ও চাঁদনি রাতে জমিতে সীমানা এঁকে স্থানীয় পলো খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো থেকে নানা খেলায় দিনমান কাটিয়ে দিতাম। মনে পড়ে, সাহেরির সময় বাড়ির ঘাটার দুয়ারে কেরোসিনের হ্যারিকেন নিয়ে চিৎকার করে বলতাম সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছে সবাই ঘুম থেকে উঠুন সেহেরি খান। সাহরির খাবার খেয়ে কেউ সহজে ঘুমুতে যেতে চাইতাম না। আড্ডা, খুনসুটিতে মেতে পড়তাম। অভিভাবকদের নির্দেশে নিরুপায়ে এক-এক করে ঘুমুতে যেতাম। যত রাতেই ঘুমানো হোক; সকালে ঘুম থেকে ওঠার চর্চা ছিল সবার। এভাবে কেটে যেতো আমাদের রমজানের দিন গুলো।
নাজাতের দশ দিনের শেষের দিকে আগ্রহ বাড়তে থাকে, এ যেন ঈদ ঘনিয়ে আসছে।
২৯ রমজানের যখন ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ইফতার শেষ না করে বাইরে গিয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতাম। মনটা তখনই খারাপ হয়ে যেতো যখন শুনতাম আজকে আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেনি। সবাই ভাঙ্গা হৃদয়ে ঘরে ফিরে যেতাম।
পরের দিন (চাঁদ রাতের) বিকাল হতে বিভিন্ন ধরনের আতশবাজি,তারাবাজি ফোটানো,নাছানাছি হই হুল্লোড়সহ নানান আয়োজন। মেয়েরা ঘরে ঘরে হাতে মেহেদী লাগানোর প্রতিযোগিতা মেতে উঠতো। ইফতারের পর পর সবার টেলিভিশন,রেডিওতে এক সাথে বেজে উঠতো ‘ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
বাসায় এসে হাতে মেহেদী লাগানো, লুডু খেলা, দাদা-দাদির কাছে গল্প শুনাসহ ঈদের দিন কে কি জামা পরে নামাজ পড়তে যাবে তা নিয়ে চলতো নানান আয়োজন।
ঈদের দিন সকাল ফরজ নামাজ শেষ করে বাসায় আসতাম, হালকা নাস্তা করে ঈদের নামাজ পড়ার চলতো প্রস্তুতি। সবাই সবার পছন্দ মতো পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে মা- বাবাকে সালাম করে চলে যেতাম নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ শেষ করে সবাই জন্য দোয়া করে,ঈদগাহ হতে বাইর হয়ে সালামি খোঁজা নিয়ে ছোটরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এ দিকে বড়রা সবার পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দোয়া শেষ করে একে অপরের বাসায় গিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়াসহ নানান আয়োজন দিন কাটিয়ে দিতো।
ঈদের পরের দিন এক পাড়ার সাথে অন্য পাড়ায় ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় মেতে থাকতেন সবাই। এতে করে সবার মধ্যে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ লক্ষ্যণীয় ছিলো। কারো কারো বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বৃত্তি পরীক্ষাসহ নানা আয়োজন করা হতো।
সময়ে ব্যবধানে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে এসব আয়োজন। আগের মতো বাড়িতে গিয়ে এমন আয়োজন চোখে পড়ে না। সবাই সবার মত করে ব্যস্ত।
লেখক: সংবাদকর্মী।