আমার জীবনে আর ঈদ আসেনি!

।। সাইফুল ইসলাম সুমন।।

সময়টা ২০২১ সাল। তখন আমাদের সব ঠিকঠাক ছিল। মা- বাবা, আমরা ৩ ভাই, ২ বোন, ইকরা, আনিসা, তাসফিয়া, খাদিজা, আরাফাত ও আব্দুর রহমান সহকারে ঘরটা ভরপুর ছিল। হাসিতে খুশিতে দিন কাটছে আমাদের। রমজান শেষে আসলো ঈদ। সবাই ধুমধামে ঈদের কেনাকাটা করলো। আমিও করলাম। মেজো ভাই আনোয়ার। তাকে টাকা দিলাম ঈদের পাঞ্জাবি কিনতে, সে নিজের জন্য পাঞ্জাবি না কিনে তার মেয়ে আনিসার জন্য ঝকঝকে একটি জামা কিনলেন। তাতেই সে অনেক খুশি। পরিবারের সবাই মিলে ঈদটা খুব ভাল করেই উদযাপন করলাম। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো। আনোয়ার ভাই, ভাবি আর আনিসাসহ বেড়াতে গেলেন আনিসার নানার বাড়ি। কে জানতো এটাই ছিল ভাইয়ের নিজ বাড়িতে সর্বশেষ পদচারণা। বেড়াতে গেলেন, ঘুরলেন। সবার সাথে আনন্দ উপভোগ করলেন। ভাইয়া শ^শুর বাড়ি থেকে এবার আসতেই চাচ্ছেনা।
ঈদের পরে সোমবার সন্ধ্যায় বছরে ১ম বৃষ্টি হয়েছে। তখন প্রচ- গরম ছিল। বৃষ্টি হওয়ায় সারা পৃথিবী যেন শীতল হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হওয়ার আনন্দে আমি ফেসবুকে লাইভ করেছি, আরো কত কিছু। এদিকে সন্ধ্যায় বাবা- মা গিয়েছে নানার বাড়ি। সেখান থেকেই বাবা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চিৎকার করতে করতে আসে আর বলে আমার বাবা নাই রে, আমার বাবা নাই। বাবার গলার আওয়াজ শুনে আমি সামনে দৌড়ে এগিয়ে গেলে বাবা জড়িয়ে ধরে বলে আমার আনোয়ার নাই রে বাবা, আমার আনোয়ার নাই। বাবাকে কোনমতে ঘরে ঢুকিয়ে দেখি মা কান্না করতে করতে আসতেছেন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে আমার রাজপুত্র কোথায় গেল রে, বাবা ও বাবা।
আনোয়ার ভাইয়ের শ^শুর বাড়ি থেকে খবর আসল, ভাইয়া নাকি বাড়ির পার্শ্ববর্তী মাঠে বজ্রপাতে পতিত হয়ে মারা গেছেন। সে কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। ভাইয়ার শ^শুর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে অন্তত ১৫/১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়েকজন মিলে গাড়ি দিয়ে রাতেই চলে গেলাম সেখানে। ভাই যেভাবে মাটিতে পড়েছিল ওই অবস্থাটা আমার এখনো মনে হলে আমি দিশেহারা হয়ে যাই।
এদিকে বজ্রপাতে পতিত হলে পুলিশের তদন্ত প্রয়োজন হয়। তৎকালীন কচুয়া থানার ওসি মো. মহিউদ্দিন ভাই যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। পুলিশি তদন্ত শেষে ভাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ততক্ষণে চারদিকে ফজরের আজান দিতে শুরু করে। এদিকে মা কিছুক্ষণ পর পর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সারা রাত ধরে সজাগ থেকে কোন বিনিময় ছাড়াই মায়ের চিকিৎসা করেন ডা. জাকির ভাই। এর মধ্যে সবাই ফজরের নামাজ পড়া শেষ করে ভাইয়ের জানাযার সময় ও কবরস্থ করার জায়গা নির্ধারণ করলাম। এদিকে ফেসবুক জুড়ে সবাই আমার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছে। অনেকে ভেবেছে আমি হয়তো মারা গিয়েছি। ভাইয়ের মৃত্যুতে পুরো এলাকা যেন নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বাড়িতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করছে। ততক্ষণে সকাল ১০ টা বেজে যায়। ভাইকে খাটিয়া করে আনা হল আমাদের মাদ্রাসা মাঠে। চেনা অচেনা অনেক মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে ভাইকে দাদার পাশে চিরদিনের জন্য শায়িত করে রেখে আসলাম। ভাইকে হারিয়ে বাবা বাকরুদ্ধ, মা অজ্ঞান আর ভাবি বুড়ো মহিলার মত সাদা কাপড় পড়ে ঘরের এক কোণে বসে বসে কান্না করছেন। আনিসা বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কান্না করছে। আর মানুষজন এসে আমাদের সবাইকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। এ যেন আমাদের পরিবার থেকে সুখ চলে গেল। মা ভাইয়ের জন্য প্রতিনিয়ত কান্না করছে। বাবা ভাইয়ের কবরের কাছ থেকে আসতেই চাচ্ছে না। বজ্রপাতে পতিত হয়ে মারা গেলে ওই লাশ নাকি চুরি হয়ে যায়। ভাইয়ের লাশ চুরি হওয়ার ভয়ে রাত জেগে কবর পাহারা দিয়েছি। লাশ যেন চুরি করতে না পারে ভাইয়ের কবরের চারপাশ ও উপরে পাকা করে দিয়েছি।
এরপরে মা প্রতিনিয়ত ভাইয়ের জন্য কান্না করত আর আনিসা এদিক সেদিক তার বাবাকে খুঁজে বেড়াতো। তার মাঝেই একমাস অতিবাহিত হল। আমার কাছে কিছু জমানো টাকা ছিল। সে টাকা দিয়ে আমি একটি বাইক কিনব অনেক আগে থেকেই ভাবছিলাম। অনলাইনে বাইক পছন্দ করে মূল্য দেখে নিলাম। আমার কাছে যে পরিমাণ টাকা ছিল আরো কিছু বাকি থাকে বাইক কেনার জন্য। টাকার জন্য আমি যখন এদিক সেদিক ছুটাছুটি করি তখন মায়ের কাছে থাকা কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে বলে যাহ বাইক নিয়ে আয়। বাইকের শো-রুমে গিয়ে বাবার পছন্দের বাইক কিনে বাড়িতে আনলেই মা কি পরিমাণ খুশি হয়েছে তা বুঝাতে পারব না।
এর মাঝেই চলে আসে কোরবানির ঈদ। ঈদে যতটা আনন্দ হয়েছে তার চেয়ে বেশি আমাদের মাঝে শূণ্যতা বিরাজ করছে। মা ঘরের এক কোনে বসে ভাইয়ের জন্য কান্না করছে। ঈদের পরে সবাই এদিক সেদিক বেড়াতে গেল। মা খালার বাড়িতে বেড়াতে যান। সবাই শূণ্যতার মাঝেও কিছুটা আনন্দ উপভোগ করছেন। কে জানতো এটাই আমাদের ঈদের সর্বশেষ আনন্দ। আমি বিকেলে গন্ধার বাড়ি নামক স্থানে ঘুরতে যাই। কিছুক্ষণ পরেই আপুর ফোন, বলল বাড়ি আয়। আমি ভেবেছি মা অসুস্থ। দ্রুত বাড়ি এসে দেখি মা সুস্থ আছেন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। এরপর দিনই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিশ্বাস নিতে পারছেনা, বুকে প্রচন্ড ব্যাথা। ব্যাথায় মা ছটপট করছেন। বাড়িতে ডাক্তার এনে মাকে দেখে ঔষুধ খাইয়েছি, তারপরেও মা কোনভাবেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। মাকে ছোট আপু নেবুলেইজার দিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। তখন করোনার কারণে সমগ্র দেশ লকডাউন। মাকে হসপিটালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা অন্যান্য গাড়ির খোঁজ নিয়ে কোন গাড়ির সন্ধান পেলাম না। বিকেলে মাকে মনে হচ্ছে পরিপূর্ণ সুস্থ। মা ঘর থেকে বের হয়ে কবরস্থানে গিয়ে ভাইয়ের কবর দেখে অজস্রভাবে কান্না করেন। তখন মা হয়তো তার চিরদিনের বাড়িটি দেখতে গিয়েছিল সেদিন বিকেলে। সকালে মায়ের অবস্থা ঠিক আগের মত। বুকের প্রচন্ড ব্যাথা, নিশ্বাস নিতে পারছেন না। ছটপট ছটপট করছেন। মায়ের অবস্থা দেখে আমাদের সবার অবস্থা খুবই খারাপ। আমি বাইক দিয়ে এদিক সেদিক গিয়ে মায়ের জন্য ঔষুধ এনে দিচ্ছি। যে মানুষ যে ঔষুধের কথা বলে সে ঔষুধ এনে দিচ্ছি। মা অন্তত সুস্থ হোক। বেলা ১২ টার দিকে মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাকিব কাকাকে এনেছি। ওনি এসে মায়ের অবস্থা দেখে আমাকে কয়েকটি ঔষুধের নাম লিখে দেন। আমি বাইকে করে কিসের উপর দিয়ে যে কচুয়া বাজার আসছি বলে বুঝাতে পারব না। ফার্মেসিতে এসে কেন জানি আমার চোখ দিয়ে অৎান্তে পানি বের হতে শুরু করল। ততক্ষণে ঔষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরেই মাকে ঔষুধ খেতে দিলাম। ঔষুধ খাওয়ার পর মা কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন। এরপর আরেকটি ঔষুধ আনতে বললেন রাকিব কাকা। আমি ঔষুধ নিয়ে পালাখাল বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছোট আপুর ফোন। ততক্ষণে মনে হল আমার মা আর নেই। আপু বলল তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। বাড়িতে এসে দেখি মা নড়াছড়া করেন না। রাকিব কাকাকে বললাম কাকা মাকে দেখেন না। কাকা কথা বলেন না। মা বুঝি আর নেই। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। এরপর কি হয়েছে আমি আর বলতে পারব না। অন্যান্যদের মত আমি জানাযার নামাজ পড়ে মাকে কবরস্থ করে বাড়ি ফিরে গিয়েছি। মা যে নেই সেটা আমার এখনো মনে হয়নি। রাতে আমার বেশ ভালই ঘুম হয়েছে। সকালে উঠে নামাজ পড়ে ঘরে গিয়ে যখন মাকে না দেখছি তখন উপলব্ধি হয়েছে আমার মা তো আর নেই।
রোজার ঈদের এক সপ্তাহ পরে ভাই আর কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ পরে মা চলে গেল। এর পরে আমার জীবনে আর ঈদ আসে নি। ভাইয়াকে নিয়ে ভাল থেকো মা।

লেখক:নির্বাহী সম্পাদক, ক্যাম্পাস বার্তা ও
সভাপতি, প্রাণের টানে রক্তদান।