৫টাকার জন্য ৪৪টাকা খরচ!

আবু সুফিয়ান রাসেল।।
ঈদুল ফিতর মানে অন্য রকম আনন্দ। শৈশবের ঈদে বাবাকে পাশে পাইনি। চাঁদ দেখার পর শুরু হতো ফিতরের আনন্দ। মাকে দেখেছি চাঁদ উঠার পর ঈদের সকালের মিষ্টান্ন খাবার প্রস্তুুত করতে।
আজানের আগে দেখতাম মা ঘুম উঠে যেতেন। ফজরের নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত করে রান্না শুরু করতেন। ঈদের ভোরে মসজিদের মাইকে আজানের পর বিভিন্ন গজল আর কোরআন শোনতাম। আমরা নামাজ শেষে চলে যেতাম দাদা দাদির কবরের পাশে। বাড়ির সবাই কোরআন তিলাওয়াত করতাম। মুনাজাত করতাম পৃথক পৃথক ভাবে। এরপর সবাই প্রবেশ করতাম আমাদের ঘরে। এ সময়ে মা রান্না করে ফেলেছেন তিন রকমের সেমাই। সাথে রং বেরং এর সাজ পিঠা। লাচ্ছা সেমাই ছোটদের জন্য। বড়দের জন্য হাতে বানানো মোটা সেমাই। আর লম্বা এক প্রকার সেমাই রান্না হতো দুধ, নারিকেল ছাড়া।
এটা স্পেশাল মানুষদের জন্য। কিসমিস, খেজুর, দুধ, চিনি, বাদাম ও এলাচ দিয়ে রান্না করা লাচ্ছা সেমাই। এটা আমার সব থেকে প্রিয়। সুযোগ বুঝে কিসমিস আর খেজুর আলাদা করে রাখতাম।
তেলেভাজা পিঠা, ঝুরি পিঠা ছিলো কমন। খাবার প্রথম পর্বে শিশুরা। আমরা খাওয়া শেষ হলে বাড়ির মুরুব্বিরা। এরপর শুরু হতো ডাকাডাকি। পাশে ফুফুর বাড়ি। জেঠাতো ভাইদের বাড়ি প্রতিবেশী মসজিদের হুজুরকে ডেকে নিয়ে আসতাম।
বারবার ঈদগাহের মাইকে ভেসে আসতো গজল আর কোরআন তিলাওয়াত। গোসল করে চলে পাঞ্জাবি টুপি লাগিয়ে শুরু হতো সালামি সংগ্রহ। এ টাকা নিয়ে যেতাম ঈদের মাঠে। নামাজ শেষে আইসক্রিম আর মজার খাবারসহ বাড়ি ফেরা। ঈদের বিকেলে ঘুরাঘুরি।

দুই।।
বড় ভাইয়ের সাথে আমার সাড়ে চার বছর ব্যবধান। শৈশবে কিছুটা বোকা ছিলাম। যেমনটা দেখেন এখন। ঈদের আগে আব্বা একই রংয়ের জামা কাপড় আর জুতা নিয়ে আসতেন। ভাইয়া নতুন জুতা পাওয়ার পর টানা কয়েকদিন ব্যবহার করতেন। আমি ঈদের নামাজ শেষে জামা-জুতা যত্নের সাথে তুলে রাখতাম। নানার বাড়ি যেতে হবে। আর ঈদুল ফিতরে নতুন জামা কিনলেও ঈদুল আযহায় নতুন জামা কিনা হতো না।
ভাইয়া, যা করতেন তা হলো, ওনার ব্যবহারের পর জুতা প্রায় পুরাতন হয়ে যেতো। আমাকে বলতেন, চল, আমরা জুতা পাল্টা পাল্টি করি। সবাই বলবে তোর পায়ে নতুন জুতা। আমার পায়েও নতুন জুতা।
আমি বোকা মানুষ। চিন্তায় পড়ে যেতাম। একটু পর আবার অফার দিতেন। সাথে তোকে ১০ টাকা দিমু।
আমি খুশিতে বাকবাকুম। নতুন জুতা দিয়ে পুরান জুতা নিতাম।


তিন।।
বাড়ির বাসার ছোট আমি। চাচাতো জেঠাতো আমরা ৯ ভাই। ২০০৮ বা ২০০৯ সালের কথা। মোবাইল টু মোবাইলের যুগ। প্রতি মিনিট কল দিয়ে কথা বললে ছয় টাকা। শুধু রিসিভ করলে দুই টাকা মিনিট। বাড়িতে মোবাইল ছিলো আব্বার সিটি সেল। আর ঈদ উপলক্ষে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গ্রামীন সীম কিনেছেন ঢাকা থেকে আসা আমার জেঠাতো ভাই। তিনি কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন।
কেউ ফোনে কথা বলার সময় অন্যজন তাকিয়ে থাকে। কিভাবে শব্দটা যায়। যাই হোক।
ঈদ শেষে বিকালে বরুড়া থেকে চলে আসলাম নানার বাড়ি কুমিল্লাতে। বিকাল চারটার দিকে মনে হলো আমার সালামির টাকা খাটের তোষকের নিচে রেখে আসছি। টাকা তো ভাইয়া নিয়ে যাবে।
আব্বার সিটিসেল থেকে জেঠাতো ভাইকে মিস কল দিলাম। ভাইকে মিয়া ডাকতাম। বললাম, মিয়া আমি রাসেল। আমার ঈদের টাকাগুলো খাটের তোষকের নিচে রাইখা কুমিল্লা চলে আসছি। মা’র কাছে টাকাগুলো দেন। মিয়া বললো, আমি প্রজেক্টে দক্ষিণপাড়া আছি। বললাম, আপনি দ্রুত বাড়ি যান। টাকা গুলো কেউ নিয়ে যাবে। মিয়া বাড়িতে গিয়ে আমার খাটের তোষকের নিচে দেখলেন। আবার কল দিয়ে বললেন টাকা পাই না।
বললাম, বালিশের নিচে দেখেন। বললাম, মার কাছে ফোনটা দেন। মাকে বললাম, ভালো করে দেখেন। মা বললেন, এখানে পাঁচ টাকা আছে। বললাম, এটার কথাই বলছি। এটা আপনার কাছে রাখেন। ভাইয়াকে দিয়েন না।
মিয়া, ফোনটা হাতে মিয়া বললেন, তোর পাঁচ টাকার জন্য আমার মোবাইলের ৪৪ টাকা কাটছে।
তুই ৫০ টাকার কার্ড রিচার্জ করে দিস। এখন ফোনটা রাখ…. ।

লেখক:সভাপতি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ সাংবাদিক সমিতি (কুভিকসাস)।