ঈদের চাঁদ কাগজের টুপি

 

।। এইচ.এম. সিরাজ ।।
“অ মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।”

কবে থেকেই শুনে আসছি কবি নজরুলের অমর সৃষ্টি। আর যাই হোক না কেন, বছরে অন্তত একটিবার। ঘুরেফিরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি। আর অমনিই খুশির পরব বইতে থাকে চারিদিকে। টানা একটি মাসের চলমান আয়োজনে যুক্ত হয় আরো একটা নতুন মাত্রা। এটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রাত পোহালেই ঈদ। শুধু কি তাই? পশ্চিমাকাশে দেখা দেয় আরেক আনন্দ রেখা। এক ফালি বাঁকা চাঁদ। ধরাজুড়ে নেমে আসে নব বারতা। তবে আজকাল কেন জানিনে, এসব আনন্দ-শিক্ষা কেবলই যেন একরকম ফিকে ফিকে লাগে। পাওয়া যায়না সেই আমেজ, সেই সার্বজনীনতা, সেই উৎসবমুখরতা। অনেকটাই কর্পোরেট আবহ ছেয়ে গেছে শহর ছাপিয়ে গ্রাম অবধিও। আনন্দ-আহার-বিহার-পোষাক-পরিচ্ছদ-শিক্ষা সকলকিছুতেই যেন কেমন একটা মেকিত্বের ছড়াছড়ি।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ছিলোনা এজাতীয় লৌকিকতা, কিংবা কর্পোরেট ভাবধারা। মানুষ মেতে ওঠতো ঈদের নির্মল-নির্ভেজাল আনন্দে। হাজার বছরের এই সংস্কৃতি তাহলে বিদেয় হলো কীভাবে? ক্রসফায়ারের মাধ্যমে? যার আরেক নাম বন্দুকযুদ্ধ! তবে এতে অন্ত—ত দু’টো পক্ষ লাগে। তাহলে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির প্রতিপক্ষও তবে নিশ্চয়ই আছে! যাকে আমরা কদ্যপি প্রতিপক্ষ জ্ঞান করাতো দূরের কথা, হয়তোবা পক্ষও ভাবিনি! তাইতো সে ঘুণপোকার মতোই অতিশয় ধীরলয়ে কেটে সাফ করে দিয়েছে আমাদের হৃদয়ে ধারণকৃত বাঙালিয়ানাকে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে। এসবের বদৌলতে চালিয়ে দিয়েছে তার প্যাকেজ সংস্কৃতি। আধুনিক-অত্যাধুনিকতা জ্ঞান করে এসবেই আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছি, ভুলে গেছি আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তাকে। আমাদের অবজ্ঞা-অবহেলার কারণে দরজা দিয়ে নয়, খিরকি দিয়েই পালিয়ে গেছে আপন ঐতিহ্য। এখন গলাগলি করার বদলে গালাগাল দিচ্ছি ঘরের মানুষটাকেই! কদাচ চরিতার্থ করছি প্রতিহিংসা পরায়ণতাও।

”আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।” বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমের বিখ্যাত-জনপ্রিয় একটি গান। কারোর কাছে এমনটা পশ্চাদগামীতার নামান্তরও হতে পারে। তবে আজকালকার বাস্তবতায় এসবের অনুপস্থিতি, পরিণামে মেকিত্বের দখল মানব মনকে করছে বিষাদসম। প্রাপ্তির ব্যাপ্তিতে উবে গেছে প্রশান্তি। ঈদ আসবে, এই আশায় থাকতাম উন্মুখ। সংসারের বহুমাত্রিক চাহিদা পূরণের তরে বাবা চালাতেন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। এসব দর্শনেই তুলতাম তৃপ্তির ঢেকুর। একদম শেষ বেলায় হাতে পেতাম একটি কাগজের টুপি। এটা পেলেই যেন একেবারে ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যেতো। জুম্মাঘরে (মসজিদ) গাঁয়ের মুরুব্বি লোকেরা আদায় করতে যেতেন মাগরিবের নামাজ, আর আমরা শিশু-কিশোররা কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম পশ্চিমাকাশের পানে। ঈদের বাকা চাঁদটা দেখা মাত্রই খুশিতে আত্মহারা হয়ে আনন্দ মিছিল আর হল্লা করে ওঠতাম আপন মনের হরষে। অত:পর ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের হাতে মেহেদি লাগানোর পড়তো হিড়িক। ‘ঈদের চাঁদ কাগজের টুপি’-এ দু’টি অনুষঙ্গে ঈদের আনন্দ হয়ে যেতো একেবারে পরিপূর্ণ। এসব আজকাল একরকম স্মৃতির ডায়েরি বৈ কিছুই নয়। তথাপিও ঈদ আমাদের মাঝে সামান্যতম হলেও নতুন বারতা নিয়েই আসে-আসবে। ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়েই বছর ঘুরে আসুক ঈদ। সমাজের ধনি-নির্ধন, উচু-নিচুর মধ্যেকার বিভেদ পরিহার করার শিক্ষা দিতেই আসুক ঈদ, সেই প্রত্যাশায় সকলকে ‘ঈদ মোবারক’।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।

serajhm@gmail.com