করোনা: কাছ থেকে দেখা দুঃসহ স্মৃতি— গোলাম রাব্বানী রাব্বী
২০২০ সালের ২৬ আগস্ট। কুমিল্লা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে বাবাকে নিয়ে আমার ৮তম দিন। প্রথম কয়েকদিন হঠাৎ চিৎকার শুনে এগিয়ে যেতাম, গেলেই দেখতাম একজন মারা গেছেন। ২-৩ দিন পরে আর যেতাম না, অনুমান করে নিতাম কেউ মারা গেছেন। তখন বাবার কপালের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিতাম। এ ৮ দিনে বেশ কিছু মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী আমি। মোটামুটি স্বাভাবিক করে নিয়েছিলাম সব। এর মধ্যে একদিন বাবার অক্সিজেন লেভেল ৬৬-তে নেমে আসে। ডিউটি ডাক্তার আইসিউতে কল করেন। কিন্তু কোনো আসন খালি ছিল না। এদিকে আর না যাই। ওয়ার্ডে থেকেই বাবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। জানতাম না এ ক’দিনে এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। খুব সম্ভবত তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। বাবার পাশের একটি খালি সিটে শুয়ে ছিলাম। তখন একজন নার্স এসে আমাকে বেড ছাড়তে বললেন। আর বলে গেলেন আজ রোগীর প্রেসার বেড়ে গেছে অনেক। এখানেও একজনকে রাখা হবে। এর পরই অন্য একটা ছেলেকে ঐ বেডে এনে বসানো হয়। টি-শার্ট এর ওপর বোতাম খুলে শার্ট পরা, জিন্স সাথে ক্যাডস ভালোই ফ্যাশন সচেতন মনে হচ্ছিলো। দেখে সব ঠিকই মনে করেছিলাম। সাথে এসেছিলেন তার মা ও বড় ভাই। মাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, তিনি বললেন গতকাল জ্বর আসার পরে ডাক্তার দেখিয়েছি। এখানে নিয়ে আসতে বলেছেন ডাক্তার। আজ কিছু খাচ্ছে না। আমার ধারণা ওর কিছু হয়নি, খাবার খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। না খাওয়ায় দুর্বল হয়ে গেছে। আমি মনে মনে বুঝলাম তার কোভিডের বিষয়টা হয়তো এতটা বুঝতে পারেনি। পরে উনার কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্রটা নিয়ে দেখলাম তার বয়স ১৪ বছর। নাম হাসান। অক্সিজেন লেভেল ৮০ লেখা। তারপর হাসানের মাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম আসলেই সে অসুস্থ, তাকে দ্রুত অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া প্রয়োজন। যা বুঝলাম উনি বিষয়গুলো এতটা ভালো বুঝেন না। তার ভাইয়েরও একই অবস্থা। তার ভাইকে নিয়ে দ্রুত সিস্টার রুমে গেলাম। একজনকে ডেকে তার অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষার অনুরোধ করি। তিনি দেখলেন ততক্ষণে তা ৬৪-তে এসেছে। উনি দ্রুত কিছু ট্রিটমেন্ট দিলেন আর পরমর্শ দিলেন আইসিউতে কল দিয়ে রাখতে। তার মা এবং ভাই অনেক সিরিয়াস ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আসল অবস্থাটা অনুভব করতে পারছিলেন না। ছেলেটা ততক্ষণে বসা থেকে শুয়ে পড়েছে। একটু একটু নিঃশ্বাস ভার হয়ে উঠছিলো। তখনও সে যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। যা তার মা ভাইকে নির্ভয় দিয়েছিলো। তারপর নিজেসহ ধরে তার অক্সিজেন মাস্ক দিলাম। টুকটাক আনুষাঙ্গিক শেষ করে চিন্তা করলাম তার অক্সিজেন লেভেলটা একটু টেস্ট করি। কিন্তু ততক্ষণে তা ৫৬-তে এসে গেছে। অক্সিজেন সাপোর্টেও কাজ হচ্ছে না। রোগীরও অস্বস্তি বেড়ে গেছে অনেক। একবার বসে। একবার উঠে, শার্ট খুলে, লাইট অফ করতে বলে আবার অন করতে বলে। হাত পা ঝাঁকি মারে। দ্রুত তার ভাইকে নিয়ে আইসিউতে গেলাম। ওখানে সব খুলে বললাম। তার বয়স ও অক্সিজেন লেভেলটা একটু মিথ্যা বললাম। ৫৬ না বলে ৫০ বললাম। ডাক্তার তখন বলল ছেলেটার বয়স মাত্র ১৪। আমারও খুব ইচ্ছে করছে তাকে আনার কিন্তু আমার কি করার আছে বল? এখানে এখনও ৬ জন রোগী অপেক্ষমান। তবে আমি কথা দিলাম ওর বয়স যেহেতু কম, এখান থেকে একটা রোগী বের হলে ওকে কল করবো। উপরে এসে যখন অক্সিজেন দেখলাম, ততক্ষণে আমার মিথ্যা-সত্যি হয়ে গেছে। মানে অক্সিজেন ৫০-এ নেমে এসেছে। ওর অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে কয়েকজন নার্স এবং চিকিৎসক বেশ কয়েক রকম চেষ্টা করে গেছেন। এসব দেখতে দেখতে তার অক্সিজেন নেমে আসে খুব সম্ভবত ৪৬ বা ৪৪-এ। তখন তার অবস্থাটা ছিল এমন যে, একটা কিছু জবাই করলে যেভাবে দম যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছটপট করে; ঠিক একই রকম। তারপর তার ভাইকে নিয়ে আবার আইসিউতে যাই। তার ভাই তখন আইসিউ ডাক্তারকে বলেছিলেন স্যার যদি ২ ঘণ্টার জন্য আমার ভাইকে একটা ব্যবস্থা করে দেন। আপনাকে ১ লাখ টাকা দেবো। চিকিৎসক বললেন, দেখো তুমি যাই বলো আমি কিছু করতে পারবো না। কোনো রোগীই বের করার অবস্থায় নেই। হতাশ হয়ে ফিরে আসলাম। তখন সম্ভবত রাত সাড়ে ৯টার মতো। দেখলাম অক্সিজেন ৩৬। তার তখনকার অবস্থা নাইবা বলি। তখন একজন নার্স আমাকে আড়ালে নিয়ে বলে কি হয় আপনার? বললাম কেউ না। তার মা ভাই মনে হচ্ছিল একটু কম বুঝে বিষয়গুলো। তাই একটু সহযোগিতা করছি। তখন তিনি বললেন আল্লাহ যদি বিশেষ কোনো মিরাকেল না ঘটান, তাহলে অল্প সময়ে কিছু হতে যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর আর হাসানের কাছে যেহেতু সাহস হচ্ছিল না, আব্বাকেও ঐ বেড থেকে নিয়ে এসে জানালার পাশে একটি চেয়ারে বসালাম। আর দূর থেকে হাসানের যন্ত্রণা দেখছিলাম। নির্বাক দর্শকের মতো। এরইমধ্যে একজন নার্স থেকে শুনলাম অক্সিজেন তখন ৩২। একজন ডাক্তার সামনে দাঁড়িয়ে। এবার হাসান শান্ত হয়ে গেলো। নিমিষেই তার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেছে মনে হচ্ছিলো। একজন নার্স আমাকে ডেকে তার হাত-পা সোজা করে দিতে বললেন। আমি পারলাম না তার কাছে যেতে। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে এটাই বের হলো আমি পারবো না। ততক্ষণে মা-ভাইয়ের আজাহারি শুরু হয়ে গেছে। হাসানের অক্সিজেন-মাস্ক ভেদ করে রক্ত বেয়ে শরীর ও বেড ভিজে আছে। সে স্তব্ধ হয়ে আছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায়। এতো কিছু সারা রাত কিভাবে কেটেছিলো জানি না। বার বার মনে হচ্ছিলো আমার নিঃশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে আসছে। জানালার পাশে এসে মাস্কটা খুলে একটু স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করলাম। আমার নিশ্বাঃস সে রাত আর স্বাভাবিক হলো না। সেদিন কিছু বিষয় খুব অনুভব করলাম মৃত্যু কখনও বয়স দেখে আসে না। যেদিন সময় হবে, সব চেষ্টাকে বিফল করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে
লেখক: লাকসাম, কুমিল্লা।