কসবায় ভোটের বাম্পার ফলন ,আইনমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই চেয়ারম্যান

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
দিনভর ফাঁকা ভোটকেন্দ্র। রাতে ফলাফলে ভোটের বাম্পার। কসবায় এত ভোট এলো কোত্থেকে! সর্বত্র এখন এসবই আলোচনার বিষয়। এলাকার সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে বেশ চমকিত। এদিকে পরাজিত প্রার্থীর দাবি, নির্বাচনে ভোট কাটার মহোৎসব হয়েছে। যে নির্বাচন হয়েছে সেটা আমরা মানি না। মাননীয় আইনমন্ত্রীর এলাকায় এ ধরনের কলঙ্ক অত্যন্ত দু:খজনক। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আইনমন্ত্রীর কাছে নির্বাচন বাতিল করে সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে (২১ মে মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ৮৩ কেন্দ্রের মধ্যে ৩৮ কেন্দ্রের ভোট কাটার অভিযোগ ওঠেছে। মোট দুই লাখ ৮১ হাজার ৩৬৬ ভোটের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার ২০২ ভোট কাস্ট দেখানো হয়েছে। তিন হাজার ৯৩৩ ভোট বাতিল হওয়ায় বৈধ ভোটের সংখ্যা এক লাখ ২৬ হাজার ২৬৯টি। নির্বাচনে জয়ী ঘোষণা করা হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আপন ফুফাতো ভাই ছাইদুর রহমান স্বপনকে। তার প্রাপ্ত ভোট ৮৫ হাজার ৯৩০। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আইনমন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার ভুইয়া জীবন পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৯৫৭ ভোট। শতকরা ৪৬.২৭ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছে।
নির্বাচনের পরদিন বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে পরাজিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা বলেন, এখন পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। মাননীয় আইনমন্ত্রীর এলাকায় এ ধরণের কলঙ্ক অত্যন্ত দু:খজনক। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মনির হোসেন অভিযোগ করেন, ৩৮টি কেন্দ্র দখল করে একতরফা ভোট কাটা হয়েছে। আমাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। প্রশাসনকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভোট কাটার মহোৎসব হয়েছে। আমাদের প্রিয় নেতা আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন কসবায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের কথাকে উপেক্ষা করে কসবা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী আজহারুল ইসলাম, পৌরমেয়র এমজি হাক্কানী, জেলা পরিষদ সদস্য এমএ আজিজ, মন্ত্রীর পিএ সোহাগ ও বাবু, ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, কসবা পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মানিক, কুটি ইউপি’র চেয়ারম্যান প্রার্থী স্বপন, শিমরাইলের সাবেক চেয়ারম্যান আলম মিয়া, কায়েমপুর ইউপি চেয়ারম্যান রনির নেতৃত্বে বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট কাটা হয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রশাসনও ভোট কাটার জন্য পাগল হয়ে পড়ে। কসবার মানুষ আগামী ১০০ বছর এই নির্বাচনের কথা মনে রাখবে। কসবার সর্বস্তরের মানুষ জানেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একটি কেন্দ্রেও পাস করতো না। যে ৩৫টি কেন্দ্রে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে তার সবক’টিতে আমি পাস করেছি। শাহপুর কেন্দ্রে আমি পেয়েছি ১১৩ ভোট, আমার প্রতিপক্ষ পেয়েছে ৪৫শ’ ভোট। আকছিনা কেন্দ্রে আমি পেয়েছি ২২ ভোট, ওই প্রার্থী পেয়েছে ২৬শ’ ভোট। আমি এই কেন্দ্রে বিপুল ভোটে পাস করতাম। যে নির্বাচন হয়েছে সেটা আমরা মানি না। মাননীয় আইনমন্ত্রীর এলাকায় এধরণের কলঙ্ক দু:খজনক। মন্ত্রী মহোদয়কে আমরা ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। কসবার মানুষও বিশ্বাস করে। কিন্তু কাদের কারণে তাঁর কথার প্রতিফলন হয়নি, সেটি তাঁকে তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করি। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আইনমন্ত্রীর কাছে নির্বাচন বাতিল করে সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার দাবি করছি।
চেয়ারম্যান প্রার্থী রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন জানান, ৩৮টি কেন্দ্রের ফলাফল অস্বাভাবিক। ৬০ থেকে ৭০ পার্সেন্ট ভোট কাস্ট হয়েছে। অন্যগুলোতে ২০/২৫ পার্সেন্ট কাস্ট হয়েছে। শাহপুর কেন্দ্রে ৪৪শ’ ভোট কাস্ট করেছে। আমাকে ভোট দিয়েছে ৩৩টি। অথচ দুপুর ২টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট কাস্ট ছিলো ৫ পার্সেন্ট। দেখানো হয়েছে ৭০ পার্সেন্ট। সোনারগাঁ কেন্দ্রে ২৩শ’ কাস্ট দেখানো হয়েছে। ৩৮টা কেন্দ্রের ভোট কাটা হয়েছে। যেই ৩৫টির ভোট কাটতে পারেনি সেখানে আমি পাস করেছি। কাপ-পিরিজ প্রতীক প্রার্থীর নিজে ইউনিয়ন কুটির দুটি কেন্দ্রে ভোট কাটতে পারেনি, সেখানে আমি পাস করেছি। এখন পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। সকাল ৮টায় ভোটের শুরুতেই শিমরাইল কেন্দ্রে ভোট কাটা হয়। বেশির ভাগ কেন্দ্রে ১২টার পর ভোট কাটা শুরু হয়। ডিসি, এসপি, ইউএনও ও ওসিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কেন্দ্রের পরিস্থিতি জানালে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেয়া হচ্ছে বলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। নির্বাচনে তার এক হাজার লোক আহত হয়েছে বলেও জানান। এরমধ্যে এমদাদুল হক পলাশ নামের আমার একজন কর্মী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আমি ও আমার নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাহীন। বায়েক এলাকার ফাহিম নামের এক কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে কসবা পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. এমরান উদ্দিন জুয়েল, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা আফজাল হোসেন রিমন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ছাইদুর রহমান স্বপন ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বলেন, সুষ্ঠ ভোট হয়েছে, জনগণ শতস্ফুর্তভাবে ভোট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন। বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনের আগে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রাও বের করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ছাইদুর রহমান স্বপন বলেন, সাধারণ জনগণ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন। সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ নির্বাচনী কাজে অংশ নেওয়া প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে ৩৮টি ভোট কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে এরকম প্রশ্নের জবাবে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ছাইদুর রহমান স্বপন বলেন, ‘নির্বাচনে জনগণ ভোট দিয়েছে। তারা ফেল করেছে। তারা অনেক কথাই বলতে পারে। তাদের বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’ নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম তার বক্তৃতায়ও সকলকে ধন্যবাদ জানান। এসময় কসবা পৌরমেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি গোলাম হাক্কানী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাজী আজহারুল ইসলাম, জেলা পরিষদ সদস্য ও যুবলীগ সভাপতি আবদুল আজিজ, খাড়েরা ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান, বায়েক ইউপি চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন, কসবা পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান মো. মানিক মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কসবা ও আখাউড়া উপজেলা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন ভালো হয়েছে। কসবার নির্বাচনে কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ২০ জন জাল ভোটারকে সাজা দিয়েছে।’