কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বেহাল অবস্থা ।।ওসমান গনি।।

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা একটি অন্যতম চাহিদা। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেচে থাকার ক্ষেত্রে সব জায়গায় ই প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা ব্যতিত কোন দেশ বা জাতি চলতে পারে না। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড।  মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুুষ চলার ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ  ভাবে চলাফেরা করতে পারে না  ঠিক তেমনি শিক্ষা ব্যতিতও কোন দেশ বা জাতি চলতে পারে না। এজন্য মানব জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। সরকারের  শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পৃথিবীর যেকোন দেশই তার দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সরকারীভাবে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব না। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে এটা কোনভাবে ই সম্ভব না। তাহলে এজন্য কি আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর অসহায় লোকজন কি শিক্ষার আলোর বাহিরে থাকবে?  না! সেটা কোনভাবে ই আমাদের দেশের শিক্ষিত সচেতন মহল কোনভাবে ই মেনে নেবে না। এজন্য দেশের প্রত্যন্তঞ্চলের  শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সরকারের সহযোগী হিসাবে শিক্ষাখাত কে এগিয়ে নিতে আসেন দেশের শিক্ষিত সচেতন মহল। তারা সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারীভাবে মালিকানা ঘর মাসিক ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য টুল/ টেবিল, নূন্যতম বেতনে শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগ করে লেখাপড়া করার উপযোগী করে প্রতিষ্ঠান টি গড়ে তোলা হয়।  যেগুলো কে বলা হয় কিন্ডারগার্ডেন স্কুল।  এ স্কুলগুলো চলে সম্পূর্ণ বেসরকারীভাবে। যাদের মধ্যে সরকারী কোন সাহায্য সহযোগীতা থাকে না। এগুলো চলে প্রতিষ্ঠাতাদের পকেটের অর্থ আর এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের মাসিক বেতনে। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থে শিক্ষকদের মাসিক বেতন পরিশোধ করা হয়। বেতন/ভাতা অফিস খরচ দেযার পর যদি সামান্য কিছু অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠাতারা কিঞ্চিৎ পরিমান অর্থ নিয়ে থাকেন। যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নেয়া সম্ভব হয়নি। কারন প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করে অবশিষ্ট তেমন কোন অর্থ থাকে না। প্রতিমাসে বকেয়া ই থেকে যায়। অথচ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান সরকারী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেকগুন এগিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/ শিক্ষিকাদের রয়েছে প্রতিষ্ঠাতাদের নিকট জবাবদিহিতা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কেমন হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের উপস্থিতির হার কেমন, ছেলেমেয়েরা অনুউপস্থিত থাকে কেন, পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের ফলাফল কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কমিটির নিকট জবাবদিহি করতে হয়। যেটা কোন সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয় না।এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সকল কে একটা নির্ধারিত পরিধির মধ্যে চলতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের কারনে সারা পৃথিবী যখন অর্থনৈতিক ভাবে অচল হয়ে পড়ল তখন এ অবস্থা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল তারা কোন না কোনভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে পারলেও বাংলাদেশ সেটা পারে না। যার কারনে কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলো এক এক করে বহু স্কুল অর্থনীতির মন্দার কারনে বন্ধ হয়ে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার লোকজন বেকার হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা ঝড় পড়ল লেখাপড়া থেকে। দেশে বেড়ে গেল বাল্যবিবাহ, সাথে বেড়ে গেল শিশুশ্রম। যেটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে নিষিদ্ধ। 
 সারাদেশে শুধু অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধনকৃত স্কুলগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে। গত দেড় বছরে সরকারি-বেসরকারি কোন সহযোগিতা না পেয়ে স্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিক-কর্তৃপক্ষ। এসব স্কুলের আয়ের একমাত্র উৎসই হলো শিক্ষার্থীদের বেতন ও লেখপড়া-সংক্রান্ত উপকরণ বিক্রির অর্থ; যা গত দেড় বছর ধরে বন্ধ। এক দুই মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত অনেকেই ধার-দেনা করে, শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে, কখনও না দিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু করোনার প্রভাব যে এত সময় ধরে এভাবে বিস্তৃত হবে, বুঝতে পারেননি। এই অবস্থা থেকে যারা উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না, তারা স্কুল বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দেন। অভাবের তাড়নায় চোখের জলে প্রিয় স্কুলের বেঞ্চ, চেয়ার টেবিল বিক্রি করে দেন বলেও জানান এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতারা।
বন্ধ করে দেয়া হাজার স্কুলের মধ্যে একটা হলো ঢাকার ‘ব্রিটিশ কলম্বিয়া’ স্কুল। যা ২০০৫ সালে ধানমন্ডিতে গড়ে ওঠা নামকরা ব্রিটিশ কলম্বিয়া স্কুলটি বেশ নাম করে ফেললেও করোনার রক্তচক্ষুর কাছে তা বন্ধ করে দিতে হয়।
করোনার সময় স্কুলের শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি দিত না। নতুন সেশনে ছাত্রছাত্রী ভর্তি স্কুলের প্রধান আয়ের উৎস ছিল। ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলটি প্রথম ছয় মাস চালানো গেলেও পরে আর তা সম্ভব হয়নি। প্রায় ৩৫ জন শিক্ষক, স্কুলের অন্যান্য স্টাফদের বেতন আর স্কুল বিল্ডিংয়ের ভাড়া-সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষের। অনেক চেষ্টা করেও স্কুলটি টেকানো আর সম্ভব হয়নি। যে কয়জন ছাত্রছাত্রী স্কুলটিতে শেষপর্যন্ত ছিল, তাদের অন্য আরেকটা স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করেন ‘ব্রিটিশ কলম্বিয়া’ স্কুল।’
এ অবস্থা শুধু একটা স্কুল বা একজন অভিভাবকের না। অভিভাবকদের অনেকেই  ভাবছেন স্কুল খুলে গেলেও শতভাগ শিক্ষার্থী এখনও কোন স্কুলে উপস্থিতি নাই। ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির বিষয়ে একাধিক শিক্ষক ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, করোনা অনেকের জীবনই ওলটপালট করে দিয়েছে। অনেক অভিভাবক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। বিশেষ করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, এমন অনেকের চাকরি চলে গেছে। অনেকের কর্মস্থল থেকে বেতন কমিয়ে ফেলেছে। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবস্থা তো আরও করুণ। অনেক ব্যবসায়ী তার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। এমন যাদের অবস্থা, তারা ঢাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাবেন তা সম্ভব না হওয়ায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। আর গ্রামে যাওয়ার এই সংখ্যা নেহায়েতই কম না বলে জানান তারা। আর এ জন্যই এত দিন পর স্কুল খুললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি এখনও ৫০ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৮০ ভাগ না হলে স্কুল চালানো কঠিন বলে মনে করেন এই শিক্ষক নেতারা।হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শিক্ষক কর্মচারী কষ্টে জীবনযাপন করছেন।
‘শিক্ষার্থী উপস্থিতি না বাড়লে আরও অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। গত দেড় বছরের করোনার প্রভাবে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৮০ লাখ মানুষ আজ কোন না কোনভাবে কষ্টে আছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

 

অনেক শিক্ষক চা বিক্রিসহ নানা কর্ম করে সংসার চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ঢাকা জেলায়ই স্কুল বন্ধের এই সংখ্যা পাঁচ হাজার। আর যেসব স্কুল চলছে সেটাও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। আরও কিছু স্কুল বন্ধ হওয়ার অবস্থায় আছে।

অনেক স্কুলের মালিকরা স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দিয়েছে স্ত্রীর গয়না আর দেশের বাড়িতে থাকা জমি বিক্রি করে।
 এসব স্কুলের পাশে সরকারি-বেসরকারি বিত্তশালীদের দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে স্কুলগুলোর মালিকপক্ষরা। তাদের দাবী সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ান, তবে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো এবং এর সঙ্গে জড়িত লাখো মানুষ তাদের পেশা ফিরে পাবে। আর শিক্ষার্থীরা পাবে তাদের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনে নিবন্ধদনকৃত কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ৪০ হাজার। এর বাইরেও আছে বেশকিছু স্কুল, দেশের রাজধানী  ঢাকার বাইরে শুধু কুমিল্লা জেলার পরিসংখ্যান দেখলেই দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের চিত্র অনেকটাই বোঝা যায়। কুমিল্লার প্রায় দুই হাজার কিন্ডারগার্টেনের প্রায় ১৮ হাজারের ওপর শিক্ষক-কর্মচারী আছে যারা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বেতন বন্ধ করে দেয়ায় সংসারের দায়িত্ব পালন করতে অনেকে চাকরি ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন।
কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়,  ২০১৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লায় নিবন্ধনকৃত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৮১। তবে বর্তমানে এ জেলায় দুই হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন রয়েছে।  করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর বিশেষ করে ক্ষতির মুখে পড়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর নির্ভর করে শিক্ষকদের বেতনসহ সার্বিক কার্যক্রম চলে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের টিউশন ফি বন্ধ করে দেয়ায় স্কুল শিক্ষকদের বেতনাদি বন্ধ হয়ে গেছে।
 বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের অধিকাংশই জীবিকার প্রয়োজনে তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। সরকার শিক্ষকদের প্রতি অনেক আন্তরিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের দূরবস্থার কথা বিবেচনা করে সরকারি প্রণোদনা দেয়া একান্ত প্রয়োজন বলে তারা দাবি জানান।
বাংলাদেশে মোট কিন্ডারগার্টেনের ৯৯ শতাংশই বাসা ভাড়া নিয়ে স্কুল চালায়। হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন থেকে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বর্তমানে হাজার হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে হয়তো কিছু কিন্ডারগার্টেন আগামী জানুয়ারিতে খুলতে পারে। তবে কয়েক হাজার স্কুল চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
সরকার যদি এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের কে পাঠদান করাত, তাহলে সরকারের  জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হতো। শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের ট্রেনিং বেতন-ভাতা বাবদ সরকারকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। কিন্তু সরকারের শিক্ষাখাত কে নিরক্ষর মুক্ত করতে দেশের একটি সচেতন মহল, নিজেদের উদ্যোগে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছে।
 কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়,  করোনাকালীন সময়ে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানগুলো কে কোন সহায়তা করেনি। 
সরকারের কাছে অনুরোধ করে বলেন, কোনমতে এখনও টিকে থাকা ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষকদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও আমাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দিলে আবারও আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারব।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট