গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী মমতাজ বেগম

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরীর সহধর্মিণী। তাঁকে প্রথম দেখেছি হাবিব ভাইয়ের বাসায়। তখন তিনি পুরোপুরি সংসারী; গৃহিনী। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধকালে এবং এর আগে এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন দেখে বুঝার উপায় নেই। এটি ১৯৮১ সালের কোনো একদিনের ঘটনা। বিনয় সাহিত্য সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ কয়েকদিন আগে বললেন, আমরা এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরীর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করছি, এখানে মমতাজ বেগমকে নিয়ে একটি লেখা থাকবে না- এটা হতে পারে না। মুকুট দা (প্রবীণ সাংবাদিক প্রদীপ সিংহ রায়) একই তাগিদ দেন। মনে আছে, ২০০৫ সালের ৯ জুন বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে মমতাজ বেগম স্মারণসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর একটি ফিচার লিখেছিলাম। এরপর আর তাঁকে নিয়ে লিখা হয়নি। এ লিখাটির প্রশংসাও করেছিলেন এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী। ফিচারটির শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম স্মরণসভার প্লাটফর্ম/কুমিল্লা টাউন হলে সেদিন বসেছিল সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলা’। (দৈনিক শিরোনাম, ১৪ জুন ২০০৫)

দুই.
মমতাজ বেগম ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রকিবুদ্দিন আহমেদ ও মা শামসুন্নাহার। এ দম্পত্তির ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। তাঁর পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বাসিন্দা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা মুজিব বাহিনী কমা-ার সৈয়দ রেজাউর রহমান এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণকালে বলেছেন, ‘হাবিব ভাইয়ের সাথে বেশ কিছু বিষয়ে আমার সামঞ্জস্য রয়েছে। তন্মধ্যে একটি বিষয় হচ্ছে, তিনি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে নবীনগরের মেয়ে মমতাজ বেগমকে বিয়ে করেন। অন্যদিকে আমিও ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে কসবার মমতাজ বেগমকে বিয়ে করি’। রেজা ভাইয়ের সাথে হাবিব ভাইয়ের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ওদিকে যাবো না। তবে মমতাজ বেগম কী নবীনগরে নাকি তাঁর মামার বাড়ি ঢাকার শাহজাহানপুরে জন্মেছিলেন- এ তথ্য জানা যায় নি। জেনেছি, তিনি লেখাপড়া করেছেন খিলগাঁও স্কুল ও সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলে। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৭১ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। বাবা পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্টের চাকুরির সুবাদে চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। মামা আতিকুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশে মমতাজ বেগমও স্কুল জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বভাবে প্রতিবাদী ছিলেন।

১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ৭০ সালে দেশ কৃষ্টি আন্দোলন ও একই বছর নির্বাচনে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও প্রচ- সাহসী নেত্রী ছিলেন। শাহজাহানপুর খিলগাঁও এলাকার স্কুল কলেজ থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় মিছিল মিটিং-এ নিয়ে আসতেন। ৭০-৭১ সালে ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মকা-ে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং প্রথম সারির নেত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পক্ষান্তরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পতাকা দিবসে মিছিলের অগ্রভাগে রাইফেল হাতে যে অবিস্মরণীয় ছবিটি দেখতে পাই সেটি মমতাজ বেগমের। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেদিন তিনি সহ আরো অনেকে রোকেয়া হলে অবস্থান করছিলেন। এরপর কজন মিলে আশ্রয় নেন রোকেয়া হলের হাউস টিউটরের বাসায়। সেখানে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফরিদা বেগম সাকিসহ ৭-৮ জন একটি স্টোর রুমে লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে, তাঁরা সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। ছাত্রলীগ নেতারা ভেবেছিলেন তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। সেখান থেকে বের হয়ে তাঁরা যে যার আত্মগোপনে চলে যান।

মমতাজ বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর পৌছে নৌকা যোগে কখনও পায়ে হেঁটে আগরতলা পৌঁছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। লেম্বুছড়া ক্যাম্পে ভারতীয় মেজর শর্মার নেতৃত্বে ৮ জন মেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মমতাজ বেগম তাঁদের অন্যতম।

তিন.
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭২ সালে ডাকসু ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে তিনি একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা পদে নির্বাচিত হন। এ বছর ৩১ অক্টোবর সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এক সভায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ছিলেন। এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী ছিলেন জাসদ জাতীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক। ১৯৭২ সালেই জাসদের মিছিলের উপর সে-সময়কার সরকারি বাহিনীর বেপরোয়া হামলার মুখেও তাঁরা দলের নীতিতে অনড় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদের মিছিলে আবারো হামলা হলে মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে মমতাজ বেগমও গুরুতর আহত হন। তাঁকে বেহুশ অবস্থায় গ্রেফতার করে ঢাকা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, ৩ জন নিহত ১৮ জন আহত হয়েছেন। জাসদ দাবি করে, অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছেন। এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী ও মমতাজ বেগম ছিলেন আপসহীন। এ প্রসঙ্গে হাবিব উল্যা চৌধুরীর ভাষ্য:
‘মমতাজ (হাবিব উল্যা চৌধুরীর সহধর্মিণী) আমারে কইছিল, গুলি প্রথমে আমাদের লোকেরাই করেছে। প্রথমে শুনলাম, গুলি করছে হাবিবুল হক খান বেনু। পরে জানলাম, এইডা হাসানুল হক ইনুর কাম। সিরাজুল আলম খানকে জিগাইলাম, পোলাপান সব মইরা যাইতেছে, কী ছাতার বিপ্লব করেন! সে জবাব দেয় না। প্রশ্ন করলেই সাইড কাইট্টা যায়। ভলিউম ঘাইট্টা খালি তত্ত্ব ঝাড়ে’। (পূর্ব বাংলার সাত দশকের কমিউনিস্ট রাজনীতি, পৃষ্ঠা-১৪২)।

মমতাজ বেগম হাবিব উল্যা চৌধুরীর মতোই সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলতেন। ত্যাগী এ নেত্রী সারাটা জীবন ত্যাগই স্বীকার করেছেন। বাহ্যিক মোহে তিনি কখনও আবিষ্ট হন নি। ১৯৭৯ সালে তিনি এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরীর সাথে দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ সালের ৯ জুন লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি অকাল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এক পুত্র- হানিফ উল্যাহ চৌধুরী সরল ও এক কন্যা- শ্রাবণী চৌধুরীর জননী। আজকাল রাজনীতিতে সত্যকে সত্য বলা ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার লোকের আকাল। রাজনীতিকে গণমুখী করতে সৎ সাহস নিয়ে কথা বলতে হবে- যার প্রোজ্জ্বল উপমা ছিলেন মমতাজ বেগম ও এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।