‘গরুর মাংস কিন্না খাওনের কপাল আমগো নাই!’

ইলিয়াছ হোসাইন।।
জুয়েল মিয়া। কাঁধে ওড়া-কোঁদাল,গলায় গামছা,পরনে মলিন শার্ট। দাঁড়িয়ে আছেন মাংসের দোকানে। দোকানদার কতোটুকু লাগবে জিজ্ঞেস করতেই- মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছেন না ভাই, লাগবো না। দাম কমুক। এখন দেখতে আইছি, দেইখা যাই। গরু মাংস কিনে খাওনের আমগো সাধ্য নাই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে- এমন ঘটনা ঘটছে দেশের আনাচে-কানাচে থাকা দিন মজুর এবং মধ্যবিত্ত মানুষের সাথে। এক কেজি গরুর মাংস যেন জন সাধারণের নিকট এখন বিলাসী খাবার। কেউ নিজের চাপা কষ্টের কথা বলছেন;আবার কেউ কেউ দেশের বাজার অস্থিতিশীলতা নিরবে সহ্য করে যাচ্ছেন।
কুমিল্লা নগরীর কয়েকজন দিনমজুরসহ মধ্যবিত্তের কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে তার জীবন যাপন।
কুমিল্লা সার্কিট হাউজের সামনের রাস্তায় খাড়ি-কোঁদাল কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কামাল মিয়া। বাড়ি দাউদকান্দি। শহরে নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করেন। স্ত্রী-ছেলেসহ তিনজনের ছোট সংসার। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের সময় মানুষের দেয়া গরুর মাংস বউ-পোলার মুখে তুইলা দিবার সুযোগ পাইছি। গরু মাংস কিন্না খাইতাম পারিনা। এক কেজি গরুর গোস্তের দাম ৭৫০টেয়া। কিন্না কেমনে খামু কন! সারাদিন খাটুনি দিয়া পাই ৬’শ টেয়া;কোনদিন আবার কাজ-কাম থাহেনা। বাজারের যা অবস্থা এই টেহা দিয়া চাল-ডাল-তেল কিনমু,নাকি গরু মাংস কিনমু ?
মো. মিজান(ছদ্মনাম)। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন,যে বেতন পাই সেই বেতনে শহরে বর্তমানে একটা ভালো মানের বাসাও ভাড়া পাওয়া যায় না। নগরীর একটি এলাকায় অল্প টাকায় দু’রুমের পুরাতন একটি বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ কোন রকম দিনযাপন করছি। সন্তানদের পুষ্টিকর খাবার কি দেবো;বাজার দরের চিত্র দেখলে এমনিই মাথা ঘুরে যায়! বাজারে চাল-ডাল-তেল-সবজি কিনার পর পকেটের টাকা ফুরিয়ে যায়;গরু মাংসতো দূরের কথা,মাছই কেনা যায় না! মাছ-মাংস আমাদের জন্য এখন বিলাসী খাবার। মাংস খেতে ইচ্ছে করলে কয়েকবার ভেবে পকেটে হাত দিতে হয়। আমার মেয়েটা গরুর মাংস খাওয়ার জন্য কয়েকদিন ধরে জ্বালাচ্ছিলো;অসুস্থ মেয়ে। বাবার মন,কতো সহ্য করা যায়। গত মাসে এক বন্ধুর থেকে টাকা ঋণ নিয়ে এক কেজি গরুর মাংস বাসায় নিয়ে যাই।


নগরীর প্রাণ কেন্দ্র ধর্মসাগরপাড়। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় দুই পরিচ্ছন্ন কর্মী মো.লিটন ও জরিনা বেগমের সাথে। তারা খালাতো ভাই-বোন। থাকেন নগরীর ১৭নং ওয়ার্ড সুজানগর। ধর্মসাগর থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত ঝাড়ু দেন। মাসিক বেতন দিয়ে ঘর ভাড়া,সংসারের খরচাপাতি ক্রয় করে অবশিষ্ট কোন টাকা থাকে না। তারা বলেন,আমি আর ভাইটা অসুস্থ। অসুস্থ পা’ডা নিয়া কামে আইয়া পড়ি। ঔষধ কিন্নাই খাইতে পারিনা আবার গরুর মাংস। আমরা টোয়াইয়া পাইয়া যা খাই তাই খাওন হয়। আমগো গরু মাংস কিন্না খাওনের কপাল নাই!

সন্ধ্যায় কথা হয় ফেরিওয়ালা আতাউর রহমানের সাথে। দেশের বাড়ি জামালপুর। নগরীর চানপুর বন্দিশাহী মসজিদের পাশে ভাড়া থাকেন। স্ত্রী-সন্তানসহ চারজনের সংসার। ভ্যানে চিংড়ি,ডিমের বরা ভেজে ফেরি করে বেড়ান। দৈনিক আয় করেন ৬’শ থেকে ৭’শ টাকা। তিনি বলেন ‘আমগো যে ইনকাম তা দিয়া গরুর মাংস কিনা যায় না। ইচ্ছে করলে কি হইবো। সাধ্য থাকতে হইবোতো। কারো থাইকা টাকা টান দিয়া আইন্না পোলাপাইনরে খাওয়ান লাগে।
রেজাউল করিম,মোগলটুলি মোড় এবি ব্যাংকের বুথের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে আছেন।
১২ঘন্টা ডিউটি। থাকেন গোমতীর উত্তরপাড় বসন্তপুর। আক্ষেপের স্বরে তিনি জানান,বাজারই চলেনা আবার গরু মাংস! বিদ্যুৎ বিল এ মাসে ২২’শ,গত মাসের বকেয়াসহ ৩হাজার টাকা দিতে হবে। খাবার দাবার কি খাবো কারেন্ট বিল দিয়াই কুলাইনা।
গরু মাংস ব্যবসায়ী মো.বিল্লাল হোসেন। দক্ষিণ দিকের ১নং গেইট দিয়ে রাজগঞ্জ মাছ বাজার ঢুকতেই তার মাংসের দোকান। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি কেজি গোস্ত ৭৫০টাকা করে বিক্রি করছি। বেচা-বিক্রি আগের তুলনায় খুব কম।
গরুর অনেক দাম বাড়া। তাই মাংসের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছেনা। কেউ কেউ আসে ৫কেজি,১০কেজি কিন্না লইয়া যায়। আবার কিছু পরিচিত ব্যক্তি আছে,কোম্পানিতে চাকরি করে। এই মানুষেরাও এক কেজি মাংস কিনার সময় বার বার চিন্তা করে। গরিবরাওে তো দেখিইনা।
বাজারের আরেক মাংস ব্যবসায়ী অব্দুল মান্নান। তিনি বলেন,দিন মজুর এবং মধ্যবিত্তরা মাংস খাওন লাগবোনা। মাংস এহন ধনী লোকের খাওন। আমরা দোকানে বসিতো বুঝি। কতো জন জিগায়ে যায় কিন্তু পকেটের দিকে তাকায়ে আবার মনডা কালা কইরা চইলা যায়। এ মানুষগুলার চোখ দেখলে দুঃখ বুঝি। কি কমু কন;আমরা ব্যবসায়ীরাওতো এ কাতারেরই মানুষ।
পাশের দোকান থেকে এক ব্যবসায়ী চিৎকার করে বলছেন, সুখে নাই,মানুষ আসলেই শান্তিতে নাই।