জানালার ওপাশ থেকে


মনোয়ার হোসেন রতন।।
একদিন যে প্রজন্ম বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। আমরা ছিলাম তাঁদের উত্তরসূরি—একটি লাল-সবুজ স্বপ্নের উত্তরাধিকার। তখন সকাল গুলো ছিল শিশিরভেজা, রৌদ্র ছায়ার নকশি উঠোনে কিশোর-কিশোরীদের হাসির খেলা। রাতগুলো ছিল মোহময়—মহুয়ার গন্ধে ভেসে যেত তারুণ্যের স্বপ্ন, চাঁদের আলোয় হৃদয় গেয়ে উঠত অপার্থিব সুর—’একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শোনে…’
সেই নির্মল সময়টাই ছিল আমাদের শৈশব ও কৈশোরের স্বর্ণালি প্রহর। কিন্তু হঠাৎই জীবন হয়ে উঠল এক পাড়ভাঙা নদী। এক ঝড়ো হাওয়া এসে কেড়ে নিল আমার মমতাময়ী মা’কে। প্রথমবার অনুভব করলাম শূন্যতা
এবং বেদনা। তখনও বুঝিনি, এ শূন্যতা, এ বেদনা আমৃত্যু বহন করতে হবে।
ঠিক তখনই ‘নদী’ নামের এক কিশোরী এসে দাঁড়ায় জীবনের ছায়ায়। তার চোখে ছিল এক ভাষাহীন বিস্ময়, যার অর্থ না বুঝলেও হৃদয়ের গভীরে ঢেউ তোলে। সে ছিল আমার দেখা শ্রেষ্ঠ দেখা—কিন্তু সেই সৌন্দর্যের দিকে পৌঁছুবার কোনো সেতু ছিল না আমার।
তবুও, জীবনের বাঁকে বাঁকে খুঁজে ফিরেছি তার প্রতিচ্ছবি। কখনো প্রিয়ার চোখে মায়ের মুখ দেখেছি, কখনো ক্লান্ত পথিকের মতো একতরফা প্রেমে ডুবে থেকেছি নদী নামের মোহনায়। সেই ভালোবাসা একাকী হেঁটেছে ধানের কচি ডগায়, ধূলিমাখা নিঃসঙ্গ পথে কিংবা প্রথম জোছনার চাহনিতে।
আজো স্মৃতির স্রোতে সেই মুখ ফিরে আসে—হারানো মুখ, হারানো রূপ, হারানো সুরে। মনে হয়, কোনো শিল্পী যেন তার ধ্যানে আঁকছে সেই রূপ—’ছোট্ট বেলার শত রং করা মুখ, সুর তুলে আজও এই মনকে ঘিরে…’ সে মন খুঁজেছে এক অনাদি বিস্ময়, যেখানে সমস্ত অভিধান ব্যর্থ, সব নামতা নিষ্প্রভ।
শুধু কল্পনা নয়—অনুভূতিরা যেন জীবন্ত মানুষের মতো ভেসে ওঠে হৃদয়ের আয়নায়। ‘ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া, পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর…”
একটা নদী ছিল আমার শৈশব-কৈশোরে—ভুবনভোলানো সেই নদী, যার ঢেউ আজও বয়ে আনে নীল বেদনার ধ্বনি। সে নেই, তবু আমার চেতনায় সে জীবন্ত। অতীত যেমন মরে না, তেমনি স্মৃতির সুরও হারায় না।
আমি শুনি সেই সুর—
“পদ্মার ঢেউ রে… মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা…যারে” এ গান যেন আমাকে এক অদ্ভুত অমরতার ছোঁয়া দেয়।
তবুও, আনন্দের গানেও লুকিয়ে থাকে বিষণ্নতা। সেই বিষণ্নতা জীবন জুড়ে শূন্যতার বীজ বোনে। শৈশবের হারানো মুহূর্তগুলোই গেঁথে দিয়েছে এ গল্প—এক অলিখিত কাব্য, বেদনার কাব্য। স্মৃতির ঝরনাধারায় হারিয়ে যাওয়া এক নদীর কথা।
আমার শৈশব-কৈশোরের সৌন্দর্যের সঙ্গে জীবনে আর কিছু তুলনীয় মনে হয়নি। সেই নদী, সেই কিশোরীর সঙ্গে দেখা, সেই বিচ্ছেদ—সব মিলিয়ে এক বেদনাদায়ক পতন। তবুও সেই পতনের মধ্যেও আমি খুঁজে পেয়েছি এক শুভ্র সৌন্দর্য।
“যেখানে ব্যথা, সেখানেই সৌন্দর্য”—এ বিশ্বাসই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
মৃত্যু-ঘন আঁধারেও আমি দেখেছি এক ঝলকে ওঠা আলো। মনে পড়ে সেই চোখ—দুটি বিস্ময়ভরা চোখ, যেগুলো আজও আমার আকাশ। সেই চোখেই দেখি জীবন, প্রেম, হারানো সম্ভাবনা আর চিরন্তন বেদনার অবয়ব।
অনেক বছর পর, একদিন তাকে খুঁজে ফিরেছিলাম। পথঘাটে আলপনা এঁকে বসে ছিলাম—ভাবছিলাম, সে আসবে।
কিন্তু… সে আসেনি।
তবুও, তাঁর সেই চোখ আজও ভেসে থাকে আমার জানালার ওপাশে। জীবনের প্রতিটি সন্ধ্যায় আমি তাকিয়ে থাকি সেদিকে—যেখানে তার উপস্থিতি নেই, কিন্তু অনুপস্থিতিই হয়ে উঠেছে আমার সবচেয়ে বড় উপস্থিতি।
এ গল্প শুধুই প্রেমের নয়। এটি এক জীবনদর্শন—হারানো শৈশব, অপ্রাপ্তির বেদনা, স্মৃতির নদীতে ভাসা এক অস্তিত্বের ভাষ্য।
এ নদী আজও আমার হৃদয়ের গভীর চেতনায় বয়ে চলে—বহন করে রং, সুর আর বেদনার মিশ্র স্রোত।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে।
তবুও, আজও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফিরে যাই—আমার শৈশব, কৈশোর, আর তারুণ্যে। সেখানে একদিন হঠাৎ করেই এসেছিল—আমার ভালো লাগার মানুষ, আমার ভালোবাসার মানুষ। সে উড়ে আসতো হাওয়ায় ভেসে, অদৃশ্য কোনো চিঠির মতো। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হতো—সেখানে লেখা আছে জীবনের কোনো এক কবিতা, যা আজও আমি পুরোটা পড়ে উঠতে পারিনি। ভালোলাগা জমে থাকতো জানালার গ্রিল ধরে শিশির হয়ে, আর শব্দেরা বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকতো—তার একটুখানি উপস্থিতিতেই তারা জেগে উঠত নতুন সুরে।
কিন্তু সেই ভালোলাগা টেকেনি বেশিদিন। যেমন শ্রাবণের মেঘে রৌদ্রের টিকে থাকা অসম্ভব—তেমনি করেই হারিয়ে গেল সে, রেখে গেল এক অসমাপ্ত কবিতা আমার জীবনে।
এ শহর, এ জানালা—এটা কেবল ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়। এখানে লেগে আছে আমার মায়ের শেষ দোয়ার গন্ধ, এখানে বাজে ইতিহাসের গুলির শব্দ, আর রয়েছে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের এক পলকের ভালোলাগার নীরব পদচিহ্ন।
আজও যখন জানালার ওপাশে তাকাই, আমি শুনতে পাই—
স্বাধীনতার আর্তনাদ,
মায়ের শেষ নিঃশ্বাস,
আর সেই অব্যক্ত ভালোলাগার অসমাপ্ত প্রেমের কবিতা—
যা কোনোদিন বলা হয়নি…
এ গল্প কেবল আমার নয়—এতে মিশে আছে আমার জীবনের না বলা অনুভব, ভালোবাসার স্পর্শহীন হাত, আর শিরা-উপশিরায় কম্পন তোলা কিছু মুহূর্ত,,,যা শব্দে বাঁধা কঠিন
তবুও আজ বললাম,
জানালার ওপাশ থেকে।