ভারতঘেঁষা রাজনীতির পরিণতি

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ভারত এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা ইতিহাসের এক গর্বিত অধ্যায়। কিন্তু কালের স্রোতে এ সম্পর্ক অনেক সময়েই হয়ে উঠেছে অসম ও একমুখী—যেখানে কূটনীতি নয়, দালালচর্চাই প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য দেখানো রাজনীতিকরা শেষ পর্যন্ত জনগণের আস্থা হারিয়ে রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতা ও ব্যর্থতায় পতিত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ও ভারত: বন্ধুত্ব নাকি চাপ?
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে ‘কৌশলগত বন্ধুত্ব’ কে পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখেন। তবে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ও ফারাক্কা বাঁধ ইস্যুতে ভারতীয় নির্লিপ্ততা জনমনে সন্দেহের জন্ম দেয়। পানিবণ্টন ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা তখন থেকেই রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়।
(Rounaq Jahan, Bangladesh Politics: Problems and Issues; Badruddin Umar, The Emergence of Bangladesh)
মোশতাক আহমদ: বিশ্বাসঘাতকতা ও ভারতের নীরবতা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হন খন্দকার মোশতাক আহমদ, যাঁকে ইতিহাসে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে দেখা হয়। এ ঘটনায় ভারতের রহস্যজনক নিরপেক্ষতা ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন আজও গবেষণার বিষয়।
(Anthony Mascarenhas, A Legacy of Blood; Lawrence Lifschultz, The Unfinished Revolution)
এরশাদ শাসন: সামরিক সরকার ও ভারত-নির্ভরতা
জেনারেল এরশাদ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলেও সীমান্ত হত্যা ও পানিবণ্টন সমস্যায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আশায় ভারতের প্রতি নমনীয়তা তাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে অবশেষে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে।
(Sreeradha Datta, India Factor in Bangladesh Foreign Policy; The Daily Star Archives, 1982–1990)
শেখ হাসিনা: দীর্ঘ শাসন, ভারসাম্যহীন কূটনীতি
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়লেও জনগণের স্বার্থরক্ষায় কার্যকর সাফল্য অনুপস্থিত। তিস্তা চুক্তি আজও আলোর মুখ দেখেনি, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা চলেছে, আর ভারতীয় ট্রানজিট সুবিধায় বাংলাদেশের লাভ আজও প্রশ্নবিদ্ধ।
(Ali Riaz, Bangladesh: A Political History since Independence; The Diplomat, 2021)
বর্তমান বাস্তবতা: ভারতের ছায়ায় রাষ্ট্রনীতি?
আজকের বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব কেবল কূটনৈতিক নয়; প্রশাসন, নির্বাচন, এমনকি গণমাধ্যমেও ভারতের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। বিরোধী দল, বিশ্লেষক এবং সচেতন নাগরিকেরা প্রশ্ন তুলছেন—ভারতের প্রতি এ অতিরিক্ত নির্ভরতা কি আমাদের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না?
(Asia Times, Bertil Lintner; Al Jazeera, 2023)
ইতিহাসের শিক্ষা: জনগণই ক্ষমতার উৎস
বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের সামনে এক সুস্পষ্ট বার্তা দেয়: ভারতের তুষ্টি বা আশ্রয়ে যারা রাজনীতি করেছে, তাদের অনেকেই হয়েছেন ব্যর্থ নেতা কিংবা ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। বিদেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রাখতে হয়, তবে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। একতরফা বন্ধুত্ব কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
আমরা যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসি, তাদের মনে রাখতে হবে—ক্ষমতার প্রকৃত উৎস জনগণ, বিদেশ নয়। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে দেশের মাটি ও মানুষের শক্তিতে, বাইরের প্রভাব বা সমর্থনে নয়।
রাজনীতি হোক জনসম্পৃক্ত, রাষ্ট্রনীতি হোক সার্বভৌম। ইতিহাস হোক আমাদের শিক্ষক।
inside post
আরো পড়ুন