জীবনঃ অনুযোগ আর অভিযোগে ভরা গদ্য

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
মানুষ জন্মায় কাঁদতে কাঁদতে। পৃথিবীতে পা রাখার প্রথম মুহূর্ত থেকেই সে বুঝিয়ে দেয়—জীবনের শুরুতেই তার আপত্তি আছে। তারপর একে একে শিখে ফেলে অনুযোগ করতে, অভিযোগ জানাতে। এই পৃথিবীতে বাঁচা যেন এক চিরন্তন অসন্তুষ্টির নাম। ক্ষুধা পেলে অভিযোগ, খাবারে স্বাদ না থাকলে অনুযোগ, একটু অবহেলা পেলেই ভেতরে জমে ওঠে দুঃখের পাহাড়।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর—এটা অস্বীকার করলেও বাস্তবতা তা প্রতিদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। সুখ চাই, সম্মান চাই, ভালোবাসা চাই—সব চাই নিজের মতো করে। অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে চাই না, অন্যের কষ্ট বুঝতে চাই না। তাই তো সম্পর্কের ভেতরে জন্ম নেয় ফাটল, পরিবারে আসে দূরত্ব, সমাজে ছড়িয়ে পড়ে অসহিষ্ণুতা। সবাই চায় কিছু পেতে, কিন্তু দিতে চায় না কিছুই।
এই চার দিনের ভিক্ষে করা জীবনটা যেন শুধুই দাবি আর প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ। বাবা-মা সন্তানের কাছে, সন্তান বাবা-মার কাছে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে, বন্ধু বন্ধুদের কাছে—সবাই নিজের মতো করে কিছু চায়, কিছু দাবি করে। কেউ কিছু কম দিলে কিংবা চাহিদা অনুযায়ী না হলে শুরু হয় অনুযোগ, এরপর অভিযোগ, তারপর নীরবতা, সম্পর্কচ্যুতি, একাকীত্ব।
মানুষ মনে করে তার কষ্টই সবচেয়ে বড়। অথচ, চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়—সবাই কাঁদছে, সবাই ভাঙছে, শুধু কাঁদার শব্দগুলো আলাদা। কেউ চুপচাপ কান্না করে, কেউ শব্দ করে ভাঙে, কেউ আবার হাসির আড়ালে ঢেকে রাখে অসীম শূন্যতা। মানুষ নিজের কষ্টের পাহাড় দেখে, কিন্তু অন্যের ক্ষত দেখেও চুপ থাকে—কারণ নিজেকে ছাড়া অন্য কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়।
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অভিযোগ বেড়েই চলে। ছোটবেলায় খেলনা না পেলে, বড় হয়ে পড়ালেখার চাপে, তারপর চাকরি, সংসার, ব্যর্থতা—সব কিছুতেই থাকে একরাশ অভিযোগ। মানুষ ভাবে—আর একটু পেলে বোধহয় সুখ আসত। অথচ সুখ, শান্তি, প্রশান্তি—এসব জিনিস নিজের ভেতরে খোঁজার জায়গা, বাইরের নয়।
জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, অথচ আমরা সেটাকে ভরিয়ে ফেলি তিক্ততা আর হতাশায়। প্রতিদিন একটু ভালোবাসা দিলে, একটু সহানুভূতি দেখালে, কিছু অনুযোগ চুপসে যেত, কিছু অভিযোগ হারিয়ে যেত বাতাসে। কিন্তু মানুষ সে চেষ্টাটুকুও করে না। বরং, কে কত বেশি আহত হতে পারে, কে কত বেশি একা হয়ে পড়ে—সেই প্রতিযোগিতায় নেমে যায়।
জীবনের সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো—এই অভিযোগ-অনুযোগের ভেতর দিয়েই একদিন মানুষ চিরতরে চুপ হয়ে যায়। তখন আর অভিযোগ থাকে না, অনুযোগও নয়—শুধু রেখে যায় কিছু না বলা কথা, কিছু অপূর্ণ ইচ্ছা, আর কিছু বোঝা না-পাওয়ার হতাশা।
তবু মানুষ বদলায় না। নতুন কেউ জন্মায়, আবার কাঁদতে কাঁদতে, আবার অভিযোগ করতে করতে, আবার অনুযোগে ভরে তোলে চারপাশ। এভাবেই বেঁচে থাকা যেন এক চিরকালীন দুঃখ। অথচ জীবনটা যদি আমরা একটু ভিন্নভাবে ভাবতাম—হয়তো কিছু ক্ষণ অন্তত শান্তিতে থাকতাম।
