জীবন ছবি–মাসুদা তোফা

 

 

২০১৮ সাল। একটা  ছোট্ট ঘটনা আজও আমাকে বিচলিত করে।  বাসা পরিবর্তন করে এক এলাকা ছেড়ে  অন্য এলাকায়  যাত্রা।  ট্রাক  ঠিক করা  হলো । ঠেলাওয়ালাও ঠিক করা  হলো  যারা  মালপত্র বাসায় তুলে দেবে। ওরা চারজন সকাল সকাল চলে আসলো। আমি ও মালপত্র কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বাক্সবন্দি করে  তৈরি হয়ে আছি। ভেতরে ভেতরে ভীষণ মন কাঁদছে।  পুরানো বাসা তার চারপাশের স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশের জন্য। তারচেয়েও বেশি কান্না পাচ্ছে, কয়েকটি বিড়াল এখানেই রেখে যেতে হবে।কারণ  ফ্ল্যাটে এত বিড়াল রাখা যাবে না। তবে এখানে ওরা ভালো থাকবে সন্দেহ নেই শুধু  আমরা দেখতে পাবো না ।অসুখ হলে হাসপাতালে নেয়ার কেউ থাকলো না।  যাবে  দুজন। পিচকু কালু।
সেও এক ট্যাজিক কাহিনি। কাকে কাকে নেব এমন  আলোচনা চলছে কয়েকদিন থেকে । হঠাৎ আসার আগের দিন খুব আদুরে বিড়ালটা  আর ঘরে  ফিরেনি। অনেক খুঁজলাম আশেপাশে কোথাও নেই। মেয়ে বলল মা নেবে না বলেছো তাই অভিমান করে  চলে গেছে। জানি না অভিমান  কিনা, তবে তাকে আর পাই নি। আরেকজন তো রীতিমতো নাটককেও হার মানিয়েছে। তাকে নিয়ে পরে একদিন লিখবো।

যাক লোকজন বাক্স পেটরা তুলে নিচ্ছে রেখে আবার আসছে। এই চলছে সারাদিন ধরে। শেষের দিকে আমি চলে এলাম নতুন বাসায়, কারণ ওদের সব দেখিয়ে দিতে হবে, কোথায়  কিভাবে  আসবাবপত্র রাখবে। পুরাতন জায়গাটা ছেড়ে আসতে গিয়ে  বাসার সবারই  ভীষণ মন খারাপ ।  তবুও জীবন  থেমে থাকে না। জীবনে অনেক  সুন্দর ছেড়ে আসতে হয় । এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে  নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, মানে একটু সুবিধা বা অসুবিধা অথবা  কর্মস্থল পরিবর্তন হলেই এইসব বন্দোবস্ত চলে মানুষের । আরও  কতো কারণে যে এই পরিবর্তন  চলে তা কেবল যারা করেন, তারাই ভালো জানেন।
যাক যা বলার জন্য  এত কথা  তা হলো
গরীব মানুষের  কঠিন জীবন আমরা  দেখি না, উপলব্ধি ও করি না। কখনো দেখে ফেললে হয়তো  এভয়েড করে যাই বা ভাবি এটাই তার কাজ। কিন্তু কাজটা যে কতো কঠিন  তা  নিজেকে দিয়ে না ভাবলে অনুভব করা প্রায় অসম্ভব।
ওরা  চারজন। মালামাল বাসার নিচে গ্যারেজে স্তুপাকার।দারোয়ান জানিয়েছে  সব জিনিস পত্র নয়তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠাতে হবে, লিফটে নয়! লিফট নষ্ট হয়ে যাবে,  ভাবা যায়!
ওরা বলল এটা কোনো  বিষয়  না। তবুও আমি হালকা পাতলা সবকিছু লিফটে তুলতে বললাম। কিছুক্ষণ পর দারোয়ানের আপত্তি। যেনো তিনি মালিক!
এভাবে করে  সারাদিন কখনো  লিফট, কখনো  সিড়ি তে করে  আমার  আসবাব পত্র যত্নে উঠে যাচ্ছে
গন্তব্যে।  হঠাৎ  করেই আমার বড়ো  মেয়ে বলল, মা তাড়াতাড়ি আসো, দেখে যাও। আমি কাজে ব্যস্ত যেতে একটু দেরি হলো।  ততক্ষণে একটা কাজ শেষ। বলল একটু অপেক্ষা করতে হবে।  পাঁচ মিনিট  পর সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে বলল  মা দেখ, কি অমানবিক কাজ, লোকটা  মরে যাবে তো!
সত্যি আমি দেখে তখন স্তব্ধ! এমন একটা দৃশ্য দেখা’র জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, কখনো  বা ভাবিনি একবারও।
চারজনের একজন  সে কাজটি করছিলো । সম্ভবত তার অভিজ্ঞতা এ কাজের বেশি, বা  দলে সে ই করে। একজন মানুষ  একা আস্ত স্টিলের আলমারি, স্টিলের টেবিল পিঠে করে  নয় তলায় সিঁড়ি বেয়ে তুলে নিয়ে আসছে। যেটুকু দেখেছি, আমি স্তব্ধ,  হতভম্ব। বললাম তুমি  একা কেন?ইন্যরা কোথায়? হেসে বলল আমি ১৫ তলায় তুলে ফেলি সমস্যা  হয় না। বলে কি লোকটা!  আমার  তো দেখেই দমবন্ধ হবার উপক্রম। বললাম এমন করলে বাঁচবে না বেশিদিন । সে হেসে বলল আমার  অভ্যাস আছে।এই অভ্যাসের পেছনে কতো কষ্ট  শুধু সেই জানে।
তাই বলে একা একা!
আমি আজও  মনে হলেই  বিভ্রান্ত হই। কিভাবে  তা সম্ভব ! আমরা  ঠক দেখেছি তো।  মা মেয়ে ভীষণ কষ্ট  পেয়েছিলাম, আজও পাই । মনের কোণে জমে  রইলো  একরাশ  অশ্রুবিন্দু আর সমবেদনা। এর বেশি আমরা  কি আর করতে পারি।
যাক এই দৃশ্য যখন দেখলাম  ততক্ষণে  প্রায়  সন্ধ্যা সব  কিছুই  উপরে  উঠে  গেছে  তবুও ঘন্টা  খানেকের কাজ বাকি। দৌঁড়ে নিচে গেলাম  বললাম বাকি সব মালপত্র লিফটে যাবে । দারোয়ান বেটা কিছুতেই  তা হতে দিবে না। তখন  তাকে বললাম তুমি মালিক না আমি!
যাক এসব করে  কিছুটা সময় তাদের  স্বস্তি দিতে পেরেছিলাম। যদিও  আমাকে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে  হয়েছিলো।
লোকটার বয়স  বেশি না কিন্তু  আমার  মনে হলো  এই যে অকল্পনীয় ভারী বোঝা টেনে নিয়ে য্যচ্ছে প্রতিনিয়ত  ত্যতে তার , হঠাৎ জীবননাশের আশঙ্কা  ৯৯নয় শতভাগ ।  আমি এই অমানবিক  দৃশ্য কোনদিন ভুলতে পারবো না। নিজেকে  সেদিন ভীষণ অপরাধী লেগেছে। আজও  সে অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
জীবন  এতো কঠিন ! একজন ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতে গিয়ে নিজের অজান্তে বা জেনেই  বুকের পাঁজর ভেঙে  টুকরো টুকরো করে  দিচ্ছে।আর আমরা যারা বিধাতার সৌভাগ্য পেয়ে জন্মেছি, নিজেকে বড়লোক ভাবি, তারা কতটা মানবিক হতে পেরেছি?
কাজ শেষ। একটু চা পানি খাওয়ালাম যদিও তখন  সে ব্যবস্থা হয়ে উঠেনি।
যাবার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম  তুমি নিশ্চয় সবচেয়ে বেশি টাকা পাও। তা শুনে আবার  স্তম্ভিত হবার পালা। সেখানেও  বঞ্চনা।  যে লিডার, সে তাদের  কন্ট্রাক্ট দিয়েছে, হায়রে  পৃথিবীর !  সেখানেও ভাগ। যাক কাজ  শেষ হলে  কিছু বাড়তি টাকা দিয়েছিলাম  এইটুকুই।  তখন ব্যস্ততার কারণে মোবাইল  নাম্বার  রাখা হয়নি তাই আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবুও আমি  রাস্তায় ঠেলা দেখলে চেহারা মেলাতে চেষ্টা করি, যদি  কখনো দেখা  পাই। ভাবি একদিন দেখা হয়ে যাবে অথবা  সেই যে বলেছিলাম মরে যাবে! না না বাঁচুক লোকটা।  তার সংসার সন্তানদের কি অবস্থা  হবে তখন!  অথবা  সন্ধ্যা বা রাতে যখন  ঘরে ফিরে যায়, তারাও কি জানতে চায়  কি অমানবিক একটা  কাজ করে  তাদের বাবা দুটো  টাকা  নিয়ে যায় তাদের জন্য।
স্ত্রী, সন্তানরা হয়তো জানে বা জানে না।জানলেই কি করার আছে তাদের।
জীবন বড়ো  নিষ্ঠুর। এখন শুধু দুঃখ হয়, সেদিন কেন আরও একটু বেশি টাকা দিতে পারিনি। না সেদিন আমি  যা দিয়েছিলাম , তারা তা কখনো প্রত্যাশা করেনি। খুব কগুশি হয়েছিলো । প্রাপ্য টাকার পর সামান্য বখশিশ পায় বা পায় না । যতদুর মনে আছে টাকার অঙ্কটা বেশ ভালো ছিলো আর সেটি ওই অমানবিক কাজটার জন্যই  দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আর এ কাজ করবে না। তুমি মরে যাবে। শুনে হাসে, আমি  সেদিন হাসতে  পারিনি কষ্টে। আজও সে দৃশ্য দেখার কষ্ট  ভুলতে পারিনা (দুইটা স্টিলের আলমারি, টেবিল, সুকেস) একা একা নয় তলায়, ওহ!!   সেকি আমার কথা শুনবে!  তাহলে যে না খেয়ে মরতে হবে পুরো পরিবার নিয়ে। আসুন এমন  অমানুষিক পরিশ্রমী মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি। পাশে থাকি। আর ভাবি এমন অবস্থা আমারও হতে পারতো ।
আমরা এক বৈষম্যের পৃথিবী গড়ে তুলছি প্রতিনিয়ত ।
অমানবিক, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাদের বসবাস।

আমাদের সুন্দর গোছানো  জীবনের  সাথে যারা জড়িয়ে  আছে, যারা না থাকলে আমরা অচল, তাদের প্রতি আমার  শ্রদ্ধা আজীবন  ।

জয় হউক মেহনতি মানুষের

 

 

১.৫.২২ ঢাকা