তিনজনের সীমাবদ্ধতা তিন ধরনের
।। হুমায়ুন কবির।।
মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের ফোন। কই যান, হুমায়ুন ভাই? আমি যখন একাকী কোথাও পথ চলি। তখন কারও ফোনে ধরতে পারি না। অটোরিক্সার বাম দিকে বসতে হয়। কারণ বামদিকে আমার হাত দ্বারা কোন একটা অবলম্বন ধরি। অটো থেকে নেমে জবাব দিলাম মোল্লা ভাই বাদশা মিয়ার বাজার।
খন্দকারে ল্যাপটপ সারতে দিতে হবে। আচ্ছা ঠিক আছে। বলে ফোন রাখলেন। আর সেখানেই এসে হাজির হলেন মহিউদিন মোল্লা ভাই। ফাহিদ ভাই আর বন্ধু মাসুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মহিউদ্দিন ভাই উনি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকা এবং ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ পত্রিকায় কাজ করছেন। সেট আপ দিতে দিতে যোহরের আজান। জামাতে সালাতে অংশগ্রহণ করলাম।
সালাত শেষে মোল্লা ভাই বললেন- সেট আপ দিতে দিতে চলে আসব ইনশাআল্লাহ। চলেন যাই মুরাদপুরে সোহেল ভাইয়ের ওখানে। এই ভর- দুপুরে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে মোল্লা ভাই?। উনি বললেন- সোহেল ভাই কিছু মনে করার লোকই নন। দেখি চলেন। খন্দকারের সামনে থেকে রিকশায় চেপে বসলাম। গন্তব্য সোহেল ভাইয়ের বাসা। যেতে যেতে সামনে পড়লো দেশয়ালীপট্টি, যেখানে পাইকারি দই কিনেছিলাম আমার ছোট বোনের বিয়েতে।
যেতে যেতে উনি দেখালেন নবাব বাড়ি। যা আমাদের কুমিল্লার গর্ব এবং হেরিটেজের অংশ। ১৯৬৩ সালের ‘হোটেল পূরবী’ চলছে আজ পর্যন্ত। একই আসন বিন্যাসে এবং একই ঢংয়ে । লা জওয়াব। বলতে বলতে সোহেল ভাইয়ের বাড়ির সামনে। বাড়ির নাম ‘রাবেয়া মঞ্জিল’। রাস্তার এককোণে বাড়িটি। গেট খোলাই ছিল। বাড়িতে ঢুকেই কি কারণে যেন মনটা ভাল হয়ে গেল। বাম দিকে সম্ভবত একটা গাড়ির গ্যারেজ ছিল। ডান দিকে একটা বাগান। দেখে মন ভরে যায়।
লাল রঙের রঙ্গন ফুল ফুটে রয়েছে থোকায় থোকায়। তার সাথে সাদা-সবুজের সংমিশ্রণে পাতা বাহার গাছ। সামনে প্রচুর জায়গা। দোতলা বাড়ির সামনে একটা খোলা লিফট। চারটা লোহার খাম্বার ভিতরে একটা ছোট ঘর। উপরে ট্র্যান্সপারেন্ট শিটের ছাউনি। সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। দোতলায় যেতেই ভিতর থেকে আওয়াজ আসল। দরাজ কণ্ঠের আওয়াজ। ভিতরে আসেন মোল্লা ভাই। দরজা খোলাই আছে।
ভেতরে ঢুকেই চারদিকে দেখলাম। সোহেল ভাই দিল দরিয়া মানুষ। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। ভাবী প্রাইমারি স্কুলের টিচার, উনি হজ্ব করতে গেছেন। সোহেল ভাই একজন হুইল চেয়ার সারভাইভার এবং একজন ব্যতিক্রমী সমাজকর্মী। আরও অবাক হলাম সোফাটা বেতের তৈরি। ফ্লোরে মোজাইক করা। আগের বনেদী পরিবার গুলোতে এ রকম দেখা যেত। সারা ঘরে গাছ আর গাছ। অক্সিজেনের অভাব নাই।
এই দিকে গৃহকর্মীকে ডাকলেন। মোল্লা ভাই ও আমার জন্য খাবারের আয়োজন করার জন্য। তারপরও আরেক গৃহকর্মীকে ডাকলেন। মোল্লা ভাইয়ের আনা আনারস কাটার জন্য। সাথে আমার ব্যাগ থেকে আম আর কলা বের করে দিলাম। আড্ডা জমল, জ্যাম্পেশ আড্ডা। সাথে সোহেল ভাইয়ের একমাত্র ছেলে, যে কিনা এবছর “সাংবাদিকতা” বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
মনে পড়ে গেল আমার ছোট ছেলে আরহাদের কথা। সেও সোহেল ভাইয়ের মত ‘হুইল চেয়ার সারভাইভার’ অর্থাৎ সেও একজন জীবনযোদ্ধা। সে ক্লাস ফোর এ মিথিলাপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুল পড়ালেখা করে। সে ‘মেলিংগো মাইলোছিল উইথ হাইড্রোকেফালাস’ রোগে রোগাক্রান্ত। তার ও পা দুটো দিয়ে একবারেই হাঁটতে পারে না। সোহেল ভাই অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। কিভাবে আরহাদের লাইফকে কতটা সহজ করা যায়। উনি নিজের মাধ্যমে বুঝতে পারেন। আমাদের সমাজে কতটা অবহেলিত প্রতিবন্ধী শিশুরা। কতটা নিষ্পেশিত প্রতিবন্ধী শিশুরা, এমনকি তার নিজের পরিবারেও। আমাদের দেশের সমস্যা শুধুই এক্সেসিবিলিটি। সব জায়গায় যেতে পারে না।
ওই দিকে খাবারের জন্য ডাক পড়ে গেল। এই দিকে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন। দু-চার রকম ভর্তা আর রুই মাছ ভাজা। মাংস দুই ধরনের। কচুর লতি আর ডালটা ছিল খুবই মজাদার। তারপর মাংসের পালা শুরু। খাবার ব্যাপারে আমি অনেকটা কৃপণ। কারণ ডায়াবেটিস,প্রেসার আর স্ট্রোক করার পর খাবার এদিক থেকে সে দিকে গেলেই যত সমস্যা। খাবার যা-ই খাই না কেন, যেন দু- চারদিন বাঁচি। সুস্থ হয়ে বাঁচি। এই আর কি? ভাবী না থাকলেও, দুজন মহিলার আতিথেয়তার কোন কমতি ছিল। আন্তরিকতার ছাপ আরও স্পষ্ট হল যখন চা এর আয়োজন হল।
সেই আলোচনা সেই আলোচনা তারপর দেখতে দেখতে বিদায়ের ক্ষণ এসে হাজির। সোহেল ভাই একজন অসম্ভব রকমের প্রাণখোলা এবং কঠোর পরিশ্রমী। আমি শুধু দেখে যাই। উনাকে দেখি আর ততই প্রেরণাপ্রাপ্ত হই নিজের মধ্যে। তিনি সামাজিক কর্ম করেন। তার মধ্যে দুটি ব্যাচ ইংরেজি বিষয়ে পড়ান। সমাজে অনঅগ্রসর যে সকল ছেলে মেয়ে আছে শুধু তাদেরকে পড়ান। শুধু সাদকায়ে জারিয়া হিসাবে। আর সেই যে আকর্ষণ লিফট। এবার সোহেল ভাই বললেন আপনি এই লিফটে নেমে যান।
আমিও সেই লিফট ধরে নামতে নামতে কেন জানি মনে হল এভাবে যদি জান্নাতে যাওয়া যায়। সোহেল ভাইয়ের মত বেশি বেশি করে সাদকায়ে জারিয়া করতে হবে। মোল্লা ভাই আর আমি এটা ভাবতে ভাবতে বের হলাম। আরহাদ,সোহেল ভাই আর আমি তিন ধরনের সীমাবদ্ধতা। প্রতিবন্ধিতা শুধু জীবনের সব কিছু কেড়ে নেয় না। আল্লাহ তার পরিবর্তে অনেক কিছু দিয়ে যায়, আমরা কেড়ে নিয়ে যাওয়া জিনিস নিয়ে হতাশ থাকি।
লেখক:উদ্যোক্তা.মিথিলাপুর,বুড়িচং।