দর্শনীয় হয়ে ওঠছে বিজয়নগরের হাওরের বুকের পিচঢালা পথ

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।।
নদী-খাল-বিলের বুক চিরে প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘের সড়ক। হাওরের বুকে পিচঢালা পথ, দৃষ্টিনন্দন সেতু দর্শনীয়র পাশাপাশি ভাগ্য বদলে দেবে গোটা একটি উপজেলার মানুষের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে যাতায়াতে আর পাড়ি দিতে হবে না ৩৫ কিলোমিটারের অধিক পথ। সড়কটি জেলা সদরের সাথে বিজয়নগর উপজেলার কেবল দূরত্বই কমাবে না, ভূমিকা রাখবে স্থানীয় কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-অর্থনীতিতেও। এমনি উচ্ছ্বাস গোটা উপজেলাবাসী, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের।
জেলা সদর থেকে বিজয়নগর উপজেলার সিমনা পর্যন্ত সোয়া ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ‘শেখ হাসিনা সড়ক’ বিজয়নগর উপজেলার মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগ গুচিয়েছে। এখন আর ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছেনা তাদের। যানবাহন চলাচলের জন্যে এরই মধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে সড়কটি। এটি শুধু যে শহরের সাথে দূরত্বই কমাবে তা নয়; ভূমিকা রাখবে স্থানীয় কৃষি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে।
এদিকে নদী আর বিলের বুকে নির্মিত এই সড়ক আর সেতু ভ্রমন পিপাসুদের প্রিয় হয়ে ওঠেছে। খাল-বিল,নদী-হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে ভিড় করছেন শতশত মানুষ। দর্শনীয়ও হয়ে ওঠছে ‘শেখ হাসিনা সড়ক’। আগে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে সড়ক ধরে সরাইল-চান্দুরা অথবা কুমিল্লা-সিলেট সড়ক ধরে সুলতানপুর-আখাউড়া ঘুরে যেতে হতো ওই উপজেলায়। সময়ও লাগতো দেড় থেকে দুই ঘন্টা। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো বিজয়নগর উপজেলার পত্তন, চরইসলামপুর, ইছাপুরা, চম্পকনগর, সিঙ্গারবিল, বিষ্ণুপুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের। বর্ষাকালে হাওর পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে আসতে তাদের একমাত্র ভরসা ছিলো নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হাঁটা।
বিগত ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের শিরাইলকান্দি থেকে বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের সিমনা পর্যন্ত প্রায় ৯.২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হলেও এখন কাজ প্রায় শেষ। সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্রচেষ্টাতেই হয়েছে হাওরের বুকে পিচঢালা এই পথ। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সুত্র জানিয়েছে, শহর সংলগ্ন তিতাস নদীতে ৩১৫ মিটার এবং লইসকা খালে ৩০৮ মিটার দীর্ঘ দুটি সেতু এবং এর সাথে প্রায় ১২শ’ মিটার এপ্রোচ সড়ক নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। সড়ক রক্ষায় পাশে দেয়া হয়েছে ব্লক। অপরদিকে কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিবছর এই বিজয়নগর উপজেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আম, লিচু, মাল্টা ও কাঁঠালসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কৃষকরা যথাসময়ে এসব ফল জেলা শহরে নিয়ে যেতে পারতেন না। এতে করে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতেন। এখন শেখ হাসিনা সড়ক ব্যবহার করে স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফল-ফলাদি দ্রুত সময়ের মধ্যেই জেলা শহরে নিয়ে যেতে পারবেন।
সড়ক চালু হওয়ায় চরম উচ্ছ্বসিত বিজয়নগরের মানুষ। তাদের আনন্দ যেনো আর ধরছেনা। তারা এখন অনেকটা চোখের পলকেই পৌঁছাতে পারছেন জেলা শহরে। পত্তন ইউনিয়নের লক্ষ্মীমুড়া গ্রামের কৃষক মো.শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আগে উৎপাদিত শাকসবজি শহরের হাটে তুলতে দারুণ কষ্ট হতো। হাওর এলাকা হওয়ায় নৌকায় করে শহরে আসতে আসতে বেলা হয়ে যেতো। ফলে সবজির ভালো দাম পাওয়া যেতো না। এখন আমরা মাত্র আধা ঘণ্টাতেই পৌঁছাতে পারছি শহরের হাটে।’ শাহজাহান মিয়ার মতো পুরো বিজয়নগর উপজেলাবাসীর ভাগ্য বদলে দেবে এই ‘শেখ হাসিনা সড়ক’। মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বেগম জানান, ‘আগে গ্রামের আশাপাশে কলেজ না থাকায় মেয়েদের শিক্ষা স্কুল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ ছেলেরা শহরে গিয়ে পড়তে পারলেও দূরের পথ হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে মেয়েদের শহরে পড়তে দেওয়া হতোনা। এই সড়ক চালু হলে মেয়েরাও শহরে গিয়ে ভালো কলেজে পড়তে পারবে।’
এলজিইডি’র তত্ত্বাবধানে কাজটি বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স মোস্তফা কামাল’র স্বত্বাধিকারী মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিজয়নগর উপজেলাবাসীর জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। মাননীয় সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্রচেষ্টায় নির্মিত এই সড়কটি সর্বক্ষেত্রেই বিজয়নগরবাসীর আমূল পরিবর্তন ঘটাবে।নেহায়েত ব্যবসায়িক চিন্তা না করে কাজটির স্থায়িত্ব এবং গুণগত মান ভালোর দিকটিই আমাদের লক্ষ্য ছিলো। কারণ ভালো কাজের জন্যে এলাকার মানুষের কাছে আমরাও যাতে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারি, সেটি বিবেচনায় রেখেই কাজটি করেছি।’