দেখে এলাম টিপু সুলতানের শহর বেঙ্গালুরু

।। অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন ।।

বেঙ্গালুরু ভারতের দক্ষিণের উন্নত শহরের মধ্যে একটি। ব্যবসা- বাণিজ্য, শিক্ষা-আর চিকিৎসার দিক দিয়ে খুবই উন্নত। ইতিহাসের বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি টিপু সুলতানের অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত মনোমুগ্ধকর স্থাপনা বেঙ্গালুরুতে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বেঙ্গালুরুতে যাওয়া যায় না। কুমিল্লা থেকে সহজে বেঙ্গালুরুতে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে কলকাতা অথবা আগরতলা যেতে হবে। কলকাতা থেকে ট্রেন বা এয়ারে করে বেঙ্গালুরু যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে এয়ারে যেতে চাইলে আপনাকে কলকাতা বা মুম্বাই ছয় থেকে সাত ঘন্টা ট্রানজিট নিয়ে তারপর বেঙ্গালুরুতে যেতে পারবেন। তবে এগুলোর মধ্যে কুমিল্লা থেকে বেস্ট অপশনটি হচ্ছে আগরতলা এয়ারপোর্ট হয়ে যাওয়া। আমিও আমার স্ত্রী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে (সিএইচসিপি) মোসা. রাবিয়া খাতুনের বিমান-এয়ার ইন্ডিগু টিকেট ছিল আগরতলা টু বেঙ্গালুরু। আমাদের জনপ্রতি টিকেট মূল্য ছিল আট হাজার রুপি করে। তবে এয়ার টিকেট মূল্য কম বেশি হতে পারে।
আমরা কুমিল্লার বাসা থেকে সকাল ৯টায় রওয়ানা হয়ে বিবির বাজার চেক পোস্টে বাংলাদেশের কাস্টমস ওইমিগ্রেশন হয়ে আগরতলা ইমিগ্রেশন কাজ শেষে আগরতলার শ্রীমন্তপুর প্রবেশ করি। শ্রীমন্তপুর থেকে একটা প্রাইভেটকার একহাজার পাঁচশত টাকায় রিজার্ভ নিয়ে আগরতলা এয়ারপোর্টের উত্তর পাশে ভাইজান হোটেলে যাই। সেখানে মাছ,ভাত, সবজি,ডাল প্যাকেজে দুপুরের খাবার খাই একশত পঞ্চাশ রুপি দিয়ে। তারপর এই গাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্টে সামনে নেমে যাই। বেলা দুইটায় আগরতলা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের সকল ঝামেলা শেষ করে এয়ার ইন্ডিগু বিমানে উঠি। বেলা ২টা ১৫ মিনিটে ফ্লাইটে বেঙ্গলুরু কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য ছেড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় গিয়ে পৌঁছে। পূর্বে বলা ছিল আমার প্রিয় ছাত্র সাকিবুল ইসলাম শান্ত প্রাইভেটকার নিয়ে উপস্থিত থাকবেন এয়ারপোর্টের সামনে।
সাকিবুল ইসলাম শান্ত কুমিল্লা দেবিদ্বারের সন্তান। সে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ভারতের সরকারের বৃত্তি পেয়ে বেঙ্গালুর জেইন স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ফ্লাইট ক্যাডেটের শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত আছে। প্রাইভেটকার দিয়ে দেড় ঘন্টার মধ্যে আমাদের পূর্বে বুকিং দেওয়া আবাসিক হোটেল হোয়াইট ফিল্ডের কাদুগুডি এলাকায় বালাজি গেস্ট হাউজে সামনে পৌঁছে যাই। গেস্ট হাউজে উঠার পূর্বে সাকিবের ব্যবস্থাপনায় তার এক বন্ধুর বাসায় রাতের খাবার খাই। হোয়াইট ফিল্ড এলাকায় কিছু মুসলিম লোকদের বসবাস রয়েছে। এখানে মসজিদ আছে, বাংলা খাবারের কয়েকটি হোটেল ও দোকান রয়েছে। এগুলোর মালিক কলকাতার লোকজন। তারা বাংলা কথা বুঝেন, বলতেও পারেন। এখানকার পরিবেশ কিছুটা কলকাতার মত মনে হয়েছে। এ এলাকায় বিভিন্ন দামের ও মানের আবাসিক হোটেল আছে। আমাদের রুমের প্রতিদিন ভাড়া ছিল আটশত রুপি। তুলনামূলক ভাড়া কম হলেও সার্ভিস খারাপ না। কলকাতা ও আগরতলায় বাংলা টাকা দিয়ে ইন্ডিয়া টাকা নেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বেঙ্গালুরুতে এ সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ থেকে রুপি অথবা ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করে নিতে হবে। তবে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট ছাড়াও ডলার দিয়ে রুপি নেওয়া যায়। ডলার পরিবর্তনের জন্য হোয়াইট ফিল্ড এলাকায় কয়েকটা দোকান আছে। বেঙ্গালুরু বেশির ভাগ জায়গায় অনলাইনে লেনদেন করতে হয়। গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে ডাব ও কলা বিক্রেতাও অনলাইনে বিল দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। হোটেলে রাত্রিযাপন শেষে পরের দিন সকালে সাকিবসহ হোয়াইড ফিল্ড কাদুগুন্ডি বাস স্টেশন থেকে এসি বাসে মাত্র বিশ রুপি ভাড়ায় ভার্তুর রোড মনিপাল হাসপাতালে যাই। পূর্বে থেকে অ্যাপার্টমেন্ট দেয়া ডাক্তারের হঠাৎ একটি সমস্যা হওয়ার অন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাসায় চলে আসি। ডাক্তারের পরামর্শ ভালো না লাগায় আমার স্ত্রীর পরামর্শে রাতে হোটেলে এসে মনিপাল হাসপাতালে মেইন ব্রাঞ্জ পুরাতন বিমানবন্দরের শাখায় আরেকজন ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট দেই। ডাক্তার প্রথমে দেখে কয়েকটি পরীক্ষা দিলেন, বিকেলে রিপোর্ট দেখে বায়োপসি করার পরামর্শ দেন। যদি বায়োপসি পরীক্ষা করি তাহলে পরের দিন সকাল বেলা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে জানান। পরদিন সেই অনুযায়ী মনিপাল হাসপাতালে ভর্তি হই, দুপুর দুইটায় ডাক্তার বাইপসি পরীক্ষা করেন। যেহেতু বায়োপসি পরীক্ষা হয়েছে ডাক্তার ছয় ঘন্টা হাসপাতালে রেখে পুনরায় দেখে চব্বিশ ঘন্টা রেস্টে থাকতে বলেন। ডিউটি ডাক্তার দেখে রাত ৮টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বলেন পাঁচ দিন পরে রিপোর্ট পাবেন।
এবার পাঁচ দিন আর কি করবো, এবার বেঙ্গালুরু ঘুরে দেখার পরিকল্পনা। এদিকে আমার স্ত্রীর মন খারাপ বাইপসি পরীক্ষার কী রিপোর্ট আসে ও আমাদের প্রিয় সন্তান রাফি, রাইসা, মাইশা বাংলাদেশে আছেন সেই টেনশনে। একদিন পর সাকিব আমি আমার স্ত্রী যাই লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে প্রচুর গাছপালা, অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান। অনেক দুর্লভ গাছ, পাবলিক লাইব্রেরি,সরকারি জাদুঘর, শিল্প ও প্রযুক্তি জাদুঘর, মনোমুগ্ধকর বোটানিক্যাল গার্ডেন। সেখানে ঘন্টা দুয়েক ঘুরে বের হয়ে গেলাম। লালবাগ সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে দেখতে আপনার বিকেল থেকে রাত হয়ে যাবে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা চলে যাই ব্রিগেড রোডে সেখানে বেশ কিছু ব্র্যান্ডের শপ ঘুরে দেখি।
ফিরে এসে এবার রাতের খাবার পেতে অনেক কষ্ট হয়। রাত ৮টা থেকে ৮:৩০ মিনিটের মধ্যে এখানকার সব দোকানই বন্ধ হয়ে যায়। তাই ওই রাতে কলা, রুটি এবং রুমে পূর্বে কিনা আমার প্রিয় খাবার পাকা নারিকেল খাই। বেঙ্গালুরুতে সহজে পাওয়া যায় চল্লিশ রুপি দিয়ে একটি ডাব, বিশ রুপি দিয়ে একটি পাকা নারিকেল এবং আপেল ও মালটা ষাট রুপি প্রতি কেজি কেনা যায়। তবে এসব ফল আমাদের দেশের মত নয়, খেতে অনেক স্বাদ। যা একবার খাবেন কখন এগুলোর স্বাদ ভোলার মত নয়। কেউ গেলে অবশ্যই এই ফলগুলো খেয়ে আসবেন। এছাড়াও বেঙ্গালুরু শহরে প্রতি কেজি গরুর মাংস তিনশত চল্লিশ রুপি করে বিক্রি হয়।
দ্বিতীয় দিন দুপুরের খাবার খেয়ে একাই বের হলাম। মোবাইলে ইন্টারনেট সহযোগিতায় রওনা হলাম এমসি রোড, বিধান সভা দেখার। বিধান সভার ভবন খুবই অসাধারণ স্থাপনা, এছাড়াও রয়েছে প্রাচীন রাজ প্রাসাদ। এ এলাকায় অনেক দর্শনার্থী ছিল। ছবি তোলে সাথে সাথে প্রিন্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। এমসি রোড একটি সৌন্দর্যের সৌন্দর্য মন্ডিত স্থান। আকাশ বাতাস কেমন যেন স্নিগ্ধ ছড়াচ্ছে এমসি রোডে। এ এলাকার লোকজনকে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে।
ইন্ডিয়ার বাইরের দেশের লোকজনের আনাগোনা বেশি। এমসি রোড এলাকায় বড় কোন ভবন নেই, আমার মনে হয়েছে শুধু সৌন্দর্যকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে ফুলের বাগান, সুন্দর স্থাপত্য ভাস্কর্য, বহু মন্দির, বিভিন্ন ধরনের মুর‌্যাল, রাস্তা উপরে ফ্লাইওভারে গাড়ি চলছে, মাটির নিচে দিয়ে মেট্রোরেল চলছে। কিছু দোকান পাটে কাঁচা ফুলের গেইট দেওয়া আছে। বেঙ্গালুর রাস্তার গাড়ি চলার শৃঙ্খলা প্রশংসা করার মত। বেশির ভাগ জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ নেই, অটো সিগনাল গাড়ি চলে, জেম নেই বললেই চলে। পুরো বেঙ্গালুরুতে রিকশা, অটোরিকশা চোখে পড়েনি। তবে বিভিন্ন ধরনের হুন্ডা রয়েছে, প্রাইভেট গাড়ি বেশি। অনলাইনে গাড়ি ভাড়া সহজে পাওয়া যায়।
তৃতীয় দিন সাকিবসহ আমরা তিনজনই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বের হলাম বানারঘাটা ন্যাশনাল পার্ক। হোয়াইট ফিল্ড কাদুগুডি থেকে মাত্র ষাট রুপি ভাড়ায় এসি বাসে যাই বানারঘাটা ন্যাশনাল পার্ক। পার্কটিতে যাওয়ার সময় বেঙ্গালুরুর পুরো শহর দেখা যায়। পার্কের সামনে মনোমুগ্ধকর ফলক রয়েছে ও একটি অনেক বড় চিড়িয়াখানা আছে। এখানে হাতি,চিতাবাঘ, হরিণ, সাপ, বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি রয়েছে। পুরোপার্কে হাজার হাজার বানর। পার্কের পুরো এলাকার ঘুরার জন্য গাড়ি রয়েছে। বোটানিকেল এলাকায় জন প্রতি দুইশত রুপি বড় বাসে, চিড়িয়াখানা এলাকায় ছোট বারো সিটের গাড়ি জন প্রতি একশত রুপি করে ঘুরে দেখা যায়। আমরা ঘুরেছি ছোট গাড়ি দিয়ে।
ঘুরার শেষ দিনে টিপু সুলতানের ইতিহাস জানতে চলে যাই টিপু সুলতানের রাজধানী মহীশূর। মহীশূর হচ্ছে এমন একটি শহর যেখানে না গেলে আপনি সত্যিই অনেক কিছু মিস করবেন।
টিপু সুলতানের সামার প্লেস, টিপু সুলতান ফোর্ট, ন্যাশনাল পার্ক, মিউজিয়াম, ন্যাশনাল লাইব্রেরী এগুলো দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। এছাড়াও বেঙ্গালুরু আরো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে- কিউবোন পার্ক, বেঙ্গালুরু প্রাসাদ, নন্দী পাহাড়, চোল মন্দির, ইসকন মন্দির, সোসনাই মন্দির, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, মাইশোর প্রসাদ, লুম্বিনি গার্ডেন, বুগল রক পার্ক প্রভৃতি। মহীশূর যাওয়ায় জন্য হোয়াইট ফিল্ড কাদুগুডি থেকে নিয়মিত বাসের প্যাকেজ নিতে পারেন তাছাড়া ৪/৫ জন হলে টেক্সি ও সিএনজি করে যাওয়া যায়। সকাল ৬টায় বাস ছেড়ে সারাদিন মহীশূর ঘুরিয়ে আপনাকে রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে হোটেলে পৌঁছতে পারবেন।
অবশেষে বাইপসি রিপোর্ট পেয়ে ডাক্তারের পরামর্শে বাংলাদেশের ডাক্তারের দেওয়া আট প্রকারের ঔষুধ বাদ দিয়ে তিন প্রকারের ঔষুধ লিখে দিলেন। দুই বছর পর একটি পরীক্ষা করে ওয়ার্টসঅ্যাপে অথবা ই-মেইলে রিপোর্ট পাঠিয়ে যোগাযোগের কথা বলেন। ওয়ার্টসঅ্যাপ নম্বর দিয়ে দেন প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য। এবার বাড়ি ফেরার পালা। হোয়াইট ফিল্ড কাদুগুডি এসে জনপ্রতি নয় হাজার রুপি করে সকাল সাড়ে ৮টার বিমান এয়ার ইন্ডিগু টিকেট অনলাইনে ব্যবস্থা করে দিলেন সাকিব। বেঙ্গালুরু সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে বিশ রুপি দিয়ে পাকা নারিকেল। দুইটি নারিকেল কিনলাম বাংলাদেশে আনার জন্য। এয়ারপোর্টে এসে খিদে অনুভব হওয়ায় একটি পাকা নারিকেল হাত ব্যাগে রেখে ট্রলি নিচ তলায় বুকিং দেই।
বেঙ্গলুরু কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় তলায় বডি চেকিং দেওয়া হয়। তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন পাকা নারিকেল নিতে দিবেন না, কয়েকবার অনুরোধ করেছি। কে শুনে কার কথা রেখে দিলেন আমার প্রিয় পাকা নারিকেল। আহারে!…. পাকা নারিকেল এ কথা বলে এয়ার ইন্ডিগু বিমানে করে আগরতলা হয়ে চলে আসি প্রাণের বাংলায়।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ
কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।