প্রশ্ন করাই সাংবাদিকতা

 

inside post

।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী।।

সাংবাদিকতা প্রশ্নের কাজ- পেশা। প্রশ্ন করা- জানতে চাওয়াই সাংবাদিকের কাজ। সাংবাদিকতার প্রথম পাঠে এ কথাটিই শেখানো হয়। সংবাদকর্মী মূলতঃ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে। তবেই একটি ভালো প্রতিবেদন- গল্প তৈরি -বাস্তব হয়। পাঠক দূরে থেকেও ওই বাস্তবতায় বা ঘটনার সাথে বিচরণ করতে পারেন সহজেই।

সব সাংবাদিক একই প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হন। কি হচ্ছে বা ঘটেছে , কোথায় , কারা জড়িত- কে বা কার সাহায্যে ঘটনা ঘটেছে । পরবর্তীতে কেন ঘটেছে, কিভাবে এবং কখন – সম্মিলিত ভাবে এই প্রশ্নগুলো সাংবাদিকতার ভিত্তি তৈরি করে।

একজন সাংবাদিক কি ভাবে সঠিক প্রশ্ন করবেন। সাংবাদিক পরিস্থিতি ভিত্তিক সমস্যা বা ঘটনা সম্পর্কে স্বাভাবিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। সহজ, সুনির্দিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত প্রশ্নই সঠিক জুতসই প্রশ্ন বলা চলে।

সাংবাদিকরা কেন সঠিক প্রশ্ন করেন না। বিভিন্ন কারণে সবসময় সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। কখনও সময়ের সীমাবদ্ধতা, নির্দিষ্ট উৎসগুলিতে বহুগম্যতা বা অ্যাক্সেসের অভাব, বা সম্পাদকীয় নির্দেশনা দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে পারে। উপরন্তু সঠিক প্রশ্নগুলো বিষয়গত হতে পারে। সেগুলো জিজ্ঞাসা করা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। সাংবাদিকরাও পক্ষপাতিত্ব, স্টেকহোল্ডারদের চাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তারপরও সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করতে এবং শক্তিশালী ভাবে জবাবদিহি করাতে অর্থবহ ও অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার চেষ্টায় রত থাকেন।

সব সাংবাদিক কি প্রশ্ন করতে পারদর্শী। প্রশ্ন করতেও কি প্রশিক্ষণ লাগে। দক্ষতা অর্জনে জ্ঞান-চর্চা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। মুখস্ত করা প্রশ্ন দিয়ে সাংবাদিকতা চলে না। যার সাথে কথা হচ্ছে, তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। সেই কথার অর্থ কি সেটা বুঝতে হয়। তাঁর জের ধরে তাঁকে প্রশ্ন করতে হয়।

উদাহরণ এরকম, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস রায়ের পর বললেন, আমি যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম। এই কথা শুনে সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আপনি কি ন্যায় বিচার পেয়েছেন। তাহলে কি ডক্টর ইউনুসের কথা বুঝতে পারেন নি। কিছু না ভেবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে এমনটাই হয়।

সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা কি জরুরি। উত্তর হ্যাঁ। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে নাকি সমস্যাও হয়ে যায়। অবশ্য এই প্রশ্ন করা থেকেই দ্বান্দ্বিকতার শুরু বা তৈরি হয়, যা থেকে খবর বা ভেতরের খবর বেরিয়ে আসে।

গেল বছর জুনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তা স্থগিত করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। আর্জেন্টিনা ফুটবল দল বাংলাদেশে আসার আগেই ওই সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বাফুফে সভাপতির ভাষ্য। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে সাংবাদিকরা কিছু প্রশ্ন করে, তাতে কিছু প্রবলেম হয়ে যায়। কাজেই আর্জেন্টিনার সাথে চুক্তি সইয়ের আগে চুপ থাকতে চায় বাফুফে।

তা হলে সাংবাদিক কি প্রতিপক্ষ। কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে। যারা অস্বচ্ছ, নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী – তারাই সাংবাদিকদের ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে।

সাংবাদিকতা কেন কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন দেশের সাংবাদিকরা, তথা পুরো গণমাধ্যম। এমনিতেও সাংবাদিকতা মানে- কুমিরভরা পুকুরে সাতার কাঁটা। আবার এও সত্য, সাংবাদিকতার নৈতিকতা এবং মানগুলো সাংবাদিকদের জন্য প্রযোজ্য নৈতিকতা নীতি এবং ভালো অনুশীলনের অন্তর্ভুক্ত। সাংবাদিকেরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারেন।

খুব কম রাজনীতিবিদই মিডিয়াকে সরাসরি উত্তর দেন। সাংবাদিক রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন করেন। রাজনীতিবিদ হয় এড়িয়ে যান বা বিচ্যুত হন বা প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলেন। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন। বিরক্ত হওয়ার স্বাভাবিক সীমা পর্যন্ত তা করাই সৌজন্য । এর বেশি নয়। কেন সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদদের সঠিক উত্তর পাওয়ার জন্য জোর দিতে পারেন না। যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা দরকার, তার জন্যে বাধ্য করতে পারেন না। প্রশ্ন নিষ্পত্তি করা কতটা জরুরি।

জানার চেষ্টা বেশির ভাগ সময়ই প্রতিরোধের মুখোমুখি করে।
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের একে অপরের প্রয়োজন। সম্পর্কটা পারস্পরিক। তাঁদের লক্ষ্য অভিন্ন। তবে চর্চার পথ পৃথক। রাজনীতিবিদ কৃতিত্ব খোঁজে আর সাংবাদিক খবর। রাজনীতিবিদদের কঠিন প্রশ্ন করার সাংবাদিকদের অধিকার কি। সাংবাদিকতা করার যে অধিকার- জনস্বার্থ। রাজনীতিবিদের রাজনীতি করারও একই-জনস্বার্থ- কমন অধিকার। এক্ষেত্রেও বেশ মিল রয়েছে। তবে অভিন্ন স্বার্থে দ্বন্দ্ব হয় কেন। বোঝাপড়ায়, স্বেচ্ছাচারিতায়। রাজনীতিবিদ বিপদে পড়লে ভালো সাংবাদিক খোঁজেন, শরণাপন্ন হন। আবার সময় উল্টে গেলে শায়েস্তা করতে নেমে পড়েন। বিপরীত চরিত্র ধারণ করেন। আবার সাংবাদিকেরও জীবন-যাপনে কর্মে রাজনীতিবিদ লাগে।

সাংবাদিক কি তাদের ইচ্ছে মতো প্রশ্ন করতে পারে। সম্মতিতে অর্থাৎ ডাকলে পারে। তবে তাও বিষয় ভিত্তিক ও প্রাসঙ্গিক হওয়া বাঞ্চনীয়। সাংবাদিকের কি সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা নিষেধ। না, এমনটা নয়।

সাক্ষাতকারে একাধিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে বিস্তৃত, এরপর সাধারণ প্রশ্নের শুরু এবং শেষের দিকে নির্দিষ্ট প্রশ্নে চলে যেতে হয়। এমনটা গল্পের জন্য -সম্পর্ক, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রাসঙ্গিকতা তৈরিতে সহায়তা করে।

তবে নির্দোষ প্রশ্ন, অযোগ্য প্রশ্ন, অপেশাদার প্রশ্ন, প্রশংসা বা স্তুতিগাঁথা প্রশ্ন, ফরমায়েশি প্রশ্ন, প্রি-সেট প্রশ্ন বা এ্যারেঞ্জ প্রশ্ন – এসব সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও মানদণ্ডকে উল্টো প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটা জানার আগ্রহ বা প্রয়োজন নয়, এক ধরনের বাতুলতা। ক্ষমতার পক্ষাবলম্বন, সুবিধাবাদিতা। দখল বা নিয়ন্ত্রণ মানসিকতা। রাষ্ট্রীয় শীর্ষ ব্যক্তিদের বা বড় ঘটনায় এমনটা বেশি দেখা যায়।

একজন সাংবাদিক কি প্রশ্ন করবেন, কোনটি উচিত প্রশ্ন। অবশ্যই প্রাসঙ্গিক, সামঞ্জস্যপূর্ণ, বিষয়ভিত্তিক ও প্রধান- প্রয়োজনীয়। সাংবাদিকরা সম্ভবত একটি ঘটনা বা সংকটে ৬ টি মৌলিক প্রশ্ন করতে পারে। কে, কী, কোথায়, কখন,কেন, কিভাবে। যা মূলত আগে উল্লেখিত তিনটি বিস্তৃত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এতে সাত পরিস্থিতি ওঠে আসে। যা একটি আদর্শ বা ভালো খবর রচনা করতে সাহায্য করে। এগুলোই সাংবাদিকতার মূল বা ভিত্তি। প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকরা একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কিছু তথ্য পেতে চান।

একবারে খুব বেশি জিজ্ঞাসা না করা। একটিই প্রশ্ন করা। সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত। সহজ- সরল বাক্য ব্যবহারে প্রশ্নক সহজে বোধগম্য করা । দ্বৈত প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা। পরে প্রশ্ন ব্যাখ্যা করার অহেতুক অভ্যাস পরিত্যাগ করা। প্রয়োজনে উপযুক্ত বডি ল্যাগুয়েজ দিয়ে নিজ প্রশ্নকে সমর্থন করা। স্ব- অন্বেষণ, স্ব- দক্ষতা ও স্ব- দায়িত্বে প্রশ্ন করা।

গঠনমূলক প্রশ্নও শুরু হয় কে, কী, কখন, কোথায় দিয়ে। একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন একাধিক সম্ভবনার জানালা খোলে। নতুন অনুসন্ধান এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিকে পরিচালিত করে। খবরের নানা অজানা দিক- বৈচিত্র্য বা নতুন খবরের জন্ম দিতে পারে। একইসাথে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দায়িত্বের একটি সক্রিয় অবস্থানে রাখে বা নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

লেখকঃ সাংবাদিক।

আরো পড়ুন