বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন দেখা — মতিন সৈকত

 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলানিকেতন সুন্দরবন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ। ১৩৯৫০০ হেক্টরের সুন্দর বনের ৬২ ভাগ ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের। বাকি অংশ ভারতের। ৩১,১ শতাংশ এলাকা জলাজীর্ণ। সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত বলে সুন্দর বন নামটি সর্বমহলে গৃহীত। হাজারো জীব-বৈচিত্রের মধ্যেও সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত। বাঘের ৮০ ভাগ খাদ্য চাহিদা মিটায় হরিণ। সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা অগণিত। সুন্দরবন উদ্ভিদের মিলন মেলা। সরকারি জরিপ অনুযায়ী ২৪৫ শ্রেণির ও ৩৩৪ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। প্রাণী ছাড়া বনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না। সুন্দরবনে ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে উপকূলবর্তী লোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দর বনের ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৬,০১৭ কিলোমিটার বাংলাদেশের। সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস।

বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দর বনকে স্বকৃীতি দিয়েছে।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকে সুন্দরবন বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিম বঙ্গকে রক্ষা করে। সুন্দরবনকে বলা হয় পানি বিশুদ্ধকরণ পলিসঞ্চয়কারী ও ঝড় প্রতিরোধকারী।

ইতিহাস থেকে জানা যায় ১২০৩-১৫৩৮ পর্যন্ত মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের স্বত্বাধিকারী ছিল সুন্দরবন। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আয়ত্তে থাকার পর ১৯২৮ সালে বৃটিশ সরকারের অধীনস্থ হয় সুন্দরবন। ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলা প্রদেশের বন বিভাগের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে। ১৮৭৯ সালে সুন্দর বনের দায়িত্ব গ্রহণ করে বন বিভাগ।

 

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের অবদান অবিস্মরণীয়। ভূমিক্ষয়, বন্য, মাটির লবণাক্ততা হ্রাসে বিশাল ভূমিকা পালন করছে। বন প্রকৃতির সৃষ্টি। হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে সুন্দর বন। বাংলাদেশের গর্বের ধন সুন্দরবন।

সুন্দরবন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসাডর। গর্ব- ঐতিহ্য- অহংকার। ছোট দেশ বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যে ভরপুর। বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোনাপানির বন ম্যানগ্রোভ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকতও বাংলাদেশের।


সুন্দরবনের সৌন্দর্য স্বচক্ষে দর্শনের জন্য আমরা সাতজন আমি মতিন সৈকত, বাংলাদেশ প্রতিদিনের কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা, ফ্রেন্ডশীপ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এস এম মিজান, সাংবাদিক মাহফুজ নান্টু, সাংবাদিক শরীফ প্রধান, কাজী সোহেল ও মনির হোসেন সেখানে যাই।

বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ ফাউন্ডেশনের ব্যানারে কুমিল্লা থেকে বাসে ঢাকায় পৌঁছি বেলা ১১টায়। নাস্তা শেষে ১২ টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে প্রবেশ করি। বিমানে আমাদের অনেকের প্রথম ভ্রমণ বিদায় উৎসুক কৌতুহল আগ্রহ ছিল ভিন্ন মাত্রার। বোডিং পাস শেষে এয়ার বাসে উঠি। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখান থেকে বিমানে আরোহন করি। রানওয়ে অতিক্রম করে বিমান আমাদেরকে নিয়ে আকাশে উড়াল দেয়। এই প্রথম মাটি ছেড়ে আকাশ পথে ভ্রমণ। নিজেদের নিরাপত্তা কামনা করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। ৩০ মিনিট পর যশোর বিমানবন্দরে নামি।

তারপর রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়ে জোহরের সালাত আদায় করে খুলনার বাসে চড়ে বসি। জানালা দিয়ে দক্ষিণ বঙ্গের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে খুলনা মহানগরে পৌঁছি মাগরিবের সময়। সেখান থেকে সোজা মংলা বন্দরে পৌঁছি রাত ৯টায়। রাস্তার অবস্থা মারাত্মক বিপর্যয়। একজনের সিটের জায়গায় দুইজনের সিট স্থাপন করে গাড়ির মালিক প্যাসেন্জারের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। দেশের সমৃদ্ধ অঞ্চল মোংলা বন্দর দিয়ে প্রতিদিন বেশুমার মালামাল পরিবহন হয়। অথচ এ রাস্তাটিকে মনে হয় কর্তৃপক্ষবিহীন।

আমাদের প্রিয় বন্ধু টুপটাপ সম্পাদক ছড়াকার ওমর ফারুক নাজমুল দুই দিন আগে মংলা পৌঁছে হোটেল বুকিং দিয়ে রাখে। রাতে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে হোটেল এসে ঘুমাই। সকালে ফজরের সালাত আদায় করে ভোরে পূর্ব নির্ধারিত ইঞ্জিন চালিত বোটে চড়ে সুন্দর বনের সৌন্দর্য দেখার জন্য পশুর নদী দিয়ে হাড়বাড়িয়া দিকে এগিয়ে চলছি। নদীতে সূর্য উদয় প্রত্যক্ষ করি। হোটেল থেকে নিয়ে আসা নাস্তা খেয়ে আবারও সৌন্দর্য উপভোগে নজর দেই। পশুর নদী দিয়ে বোট এগিয়ে চলছে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে। দুই পাশেই সুন্দরবন দেখা যায়। ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা হাড়-বাড়িয়া ইকো রেঞ্জে পৌঁছি। ঘাটে নামতেই স্বাগত জানাতে বানরের দল এগিয়ে আসে। শুরু করে দেয় কুচকাওয়াজ। আমাদের উচিত ছিল এখানে আসার আগে বানরের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসা। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ভুল হয়ে যায়। বানর খুব বন্ধু বৎসল। একটু প্রশ্রয় পেলেই সঙ্গী হয়ে যায়। যারা বানরের সাথে বাঁদরামি করে বানর তাদের বারোটা বাজিয়ে দেয়। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষকে বানরও সম্মান করে। গানম্যানকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের সেতু দিয়ে বনের ভেতরের সৌন্দর্য মাধুর্য কিছুটা অবলোকন করি। আমাদের দলের কেউ কেউ হরিণের পাল দেখেছে। ছবি তুলেছে। তারপর বোটে ফিরে আসি। পশুর নদীর পানি নানা রকম রাসায়নিক বর্জ্যে বিবর্ণ, ঘোলাটে।

কার্গো, জাহাজ, স্টিমার বহু রকমের জলযান রাজত্ব করছে। বোট এসে ভিড়ে করম জল স্পটে। এখানে অনেক পর্যটকদের ভিড়।

নানা রকম বন্য প্রাণীর প্রজনন কেন্দ্র। আমরা নেমে দলবেঁধে ঘুরাঘুরি করি। কুমির গভীর ঘুমে বিভোর। হরিণের সাথে চলে সোহাগ বিনিময়। ছোট ছোট ঘাসের আঁটি বিক্রি হয়। হাতে ঘাস থাকলে ছাগলের মত হরিণকে খাওয়ানো যায়। এখানেও কাঠের সেতু দিয়ে বনের ভেতরের সৌন্দর্য দেখা যায়। দেখা শেষে বোটে ফিরে আসি। আসার পথে ছিল ভাটা। এখন চলছে জোয়ার। পানির আস্ফালন দেখে আল্লাহর শক্তির মহিমা অনুভব করার চেষ্টা করি। সুন্দরবনের সৌন্দর্য এত অল্প সময়ে ঝটিকা সফরে অনুভব করা সম্ভব নয়।

তারপর মংলা বন্দর থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সন্ধ্যায় ষাট গম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করে ছুটে যাই খান জাহান আলী দরগায়। সেখান থেকে ফিরে আসি খুলনা রেল স্টেশনে। রাত ১০টায় সুন্দরবন এক্সপ্রেসে উঠি। মনে হল এক ট্রেন ভ্রমণেই অর্ধেক বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষ। সকাল ৭টায় কমলাপুর রেল স্টেশন নামি। সকালের নাস্তা করে কুমিল্লার বাসে বাড়ির পথে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখার জন্য বারবার যাওয়া প্রয়োজন।

লেখক:রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষি পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন সংগঠক।