ভিক্টোরিয়া কলেজ জীবনে আমার স্মৃতি;  প্রবীর বিকাশ সরকার

 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নাতিদীর্ঘ দুই বছরের জীবনটা আমার বাংলাদেশ পর্বের মধ্যে সবচে উজ্জ্বল আনন্দমুখর এবং হারানোর দীর্ঘশ্বাসে এত ভারী যে অবিরাম ধারাপাতের শব্দ আমি শুনতে পাই। এই সময়টার খাঁচায় আমার এ্যাত স্মৃতি বন্দি হয়ে আছে যে সেখানে হাত রাখার ফাঁকটুকু নেই। নানা বর্ণে রঙিন ঘটনাবহুল মুখগুলো কাকাতুয়া পাখির মতো দাপাদাপি করে মরছে যার কিছু মুক্ত করেছি গত দু-এক বছরে ‘কুমিল্লার ঘটনামালা’ এবং ‘জীবনস্মৃতির গল্প’ সিরিজের মাধ্যমে। সবকিছু যে হুবহু মনে আছে তাও নয়। তবে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার স্মৃতিশক্তি বরাবরই স্বচ্ছ ও জোরালো। আমার এখনকার যে বয়স একান্ত স্মৃতিকথাই সাহিত্য। আমার এখন যে জীবনযাপন সব আলোগুলো নিভে নিভে আসছে—তবু একটা আলো কোথাও জ্বলছে তারই আলোয় নিজেকে দেখা আর লেখা। তাই ভাবি যে, কোথাও আলো আছে সেটাই ভরসা।

কলেজ জীবনে আমার এ্যাত বন্ধু-বান্ধবী ছিল যে অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়েছিলাম। শহরের কোন্ পাড়া বা গলির সঙ্গে আমার জানাজানি হয়নি! শাসনগাছা থেকে চকবাজার আর কালিয়াজুড়ি থেকে টমসনব্রিজ পর্যন্ত ছিল অবাধ যাতায়াত এবং আড্ডা দেয়া চায়ের দোকানে, কারো-কারো বাড়িতে বা পুকুর ঘাটে।

কিন্তু সবচে বেশি আড্ডা দিয়েছি কলেজগেটসংলগ্ন চায়ের দোকান আর ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে। এই দিঘির পশ্চিম পাড়ে আমরা দীর্ঘ বছর বসবাস করেছি। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কান্দিরপাড় হয়ে প্রতিদিন কলেজে গিয়েছি। ভিক্টোরিয়া কলেজ ছিল আমাদের উদীয়মান জীবনের ঠিকানা, তারুণ্যের আনন্দ আশ্রম। এই কলেজের ছিমছাম বিস্তৃত প্রাঙ্গণ ছিল আমাদের সেই যৌবনের উত্থানপর্বে এককথায় স্বর্গোদ্যান বা প্যাডাইজ। কলেজের পরিবেশ তখন ছিল উজ্জ্বল, তারুণ্যে টগবগকরা জীবন্ত, বিচিত্র কলহাস্যে মুখরিত। ছুটির দিনেও গমগম করতো মাঠচত্বর, রানীর দিঘির পাড়—এখানে সেখানে আড্ডা হতো থোকা থোকা বিকেল থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত (আমার ‘তালা’ উপন্যাসে এই আড্ডাগুলোর বর্ণনা আছে)।

কুমিল্লা শহরটি ছিল তখন স্বর্গভোগের অমরাবতী আমাদের জন্য। কিন্তু ১৯৭৮ সালের শেষদিকে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম তখনই স্বর্গচ্যুত হলাম যাকে বলে প্যারাডাইজ লস্ট! লস্ট হলেও সুচিক্কণ সোনালি-রূপালি স্মৃতিশস্যে যেভাবে ভরে উঠেছে দিনে দিনে আমার জীবনগোলা তাতে আমি যেমন পুলকিত তেমনি আন্দোলিত হচ্ছি এই পড়ন্ত বয়সে এসেও। অতিরিক্ত আনন্দে অনেক সময় চোখ সজল হয়ে ওঠে, এটা হচ্ছে অপার আনন্দের বৈশিষ্ট্য। এটাকেই আমি বেশি উপভোগ করি। আমার এই বিলাসী উপভোগের কেন্দ্র জুড়ে অনেক মুখ যারা ছিল সহপাঠী এবং ভিন্ন কলেজের বন্ধু—যাদের সঙ্গে ক্ষণকালীন, নাতিদীর্ঘ বা দীর্ঘায়ু সম্পর্ক একদা বিদ্যমান ছিল। এখন কে কোথায় আছে জানি না, থাকি ৭০০০ মাইল দূরে জাপান নামক দেশে। বিগত ৩৬ বছর ধরে প্রবাসী আমি। তবু ফেইসবুকের কল্যাণে কিছু পুরনো মুখ খুঁজে পেয়েছি ফলে বিচ্ছিন্ন সড়ক বা সেতু জোড়া লেগেছে। এটা পরম সৌভাগ্য। ফেইসবুককে অশেষ ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

আমার কলেজজীবনের অনেক স্মৃতি। দ্বিতীয় বর্ষে যখন উঠলাম তখন আড্ডার সময়সীমা এত বেপরোয়া হয়ে উঠলো যে যেন গৃহহীন হয়ে গেলাম আমি! দুপুরের খাবার খেয়েছি বিকেলে তারপর একরত্তি ঘুমিয়ে উঠে সন্ধেবেলা ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে না হয় কান্দির পাড়ে দাদার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে চলে গেছি। চালচলনেও কেমন যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। পড়ালেখা উঠে গেছে দেয়ালের তাকে। পড়ালেখার জায়গা দখল করে নিয়েছে আড্ডা, গানশোনা, লেখালেখি, সাহিত্যপাঠের আসর, অহেতুক দুঃখবোধে নিমগ্ন থাকা একাকিত্ব, উদাসীনভাবে গোমতী নদীর এপার ওপার ঘোরাঘুরি, দিনদুপুরে—গভীররাতে নেশায় বুঁদ হয়ে জীবনের অর্থখোঁজা—অথচ জীবন তখন শুরু হয়েছে মাত্র! এই হেয়ালিখেয়ালি সময়টাকে আজ ভাবতে এত ভালো লাগছে যে, দুচোখ ভিজে আসছে বার বার!

আমার কলেজজীবন মানেই বিভূতি, বনফুল, শরদিন্দু, রবীন্দ্রনাথ, শীর্ষেন্দু, সুনীল, দুই সমরেশ, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, অদ্রীশ বর্ধন, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, রমাপদ, বিমল কর, শক্তিপদ রাজগুরু, প্রফুল্ল, তারাশঙ্কর, প্রতিভা বসু, মতী নন্দী, শ্যামল, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, মুজতবা, গৌরকিশোর, রিজিয়া রহমান প্রমুখের অসামান্য সব গল্প, উপন্যাস। আমার কলেজজীবন মানেই কবিতার নদনদী আর পাহাড়পর্বতে ভ্রমণ আর এই ভ্রমণকে স্বপ্নময়, দুঃখময়, আবেগময়, ক্রন্দনময়, দীপ্তময়, দ্রোহী করে তুলেছিলেন অমিয়, বিষ্ণু, অজয় ভট্টাচার্য্য, সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সুধীর, শক্তি, সুনীল, তারাপদ, জয়, নীরেন্দ্রনাথ, সুভাষ, জীবনানন্দ, নজরুল, অলোক, উৎপল, অরুণ, মণীন্দ্র, বুদ্ধদেব, শরৎ, কবিতা সিংহ, শামসুর, সৈয়দ শামসুল, হাসান হাফিজুর, আতীকুল্লাহ্, রফিক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ, নির্মলেন্দু, মহাদেব, আহসান হাবীব প্রমুখ। তখনকার দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা ছাড়া আর যে সকল সাহিত্য ও চলচ্চিত্র কাগজের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম সেগুলোর ছবি এখনো জ্বলজ্বল করছে: দেশ, কৃত্তিবাস, শিলাদিত্য, চতুরঙ্গ, অনুষ্টুপ, অমৃত, প্রসাদ, উল্টোরথ, প্রতীক্ষণ, উত্তরাধিকার, বিচিত্রা ইত্যাদি। সাপ্তাহিক ‘দেশ’ তো ছিল প্রেমিকার মতো! অগ্রীম টাকা দিয়ে রাখতাম পত্রিকা ব্যবসায়ী মন্টুদার কাছে ‘দেশ’ এলেই যেন রেখে দেয়া হয়। মন্টুদা কথা রাখতেন। না রেখে উপায় আছে যে ‘চ-ীরূপ’ মেজাজ ছিল আমাদের! গলা শুকিয়ে থাকত একহৃদয় তৃষ্ণায় পুজো সংখ্যা ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘আজকাল’, ‘বর্তমান’ ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’ ‘অনুষ্টুপ’ ইত্যাদির জন্য। পড়িমরি জোরজবরদস্তি করে সংগ্রহ করতাম—এমনই ছিল আমাদের তখনকার সাহিত্য-বুভুক্ষা! কলেজের সবুজ মাঠে শুয়ে শুয়ে না হয় ফটকসংলগ্ন দিঘির পাড়ে বসে এইসব সাহিত্য সাময়িকীগুলো গোগ্রাসে পড়তাম। তখন অবশ্য যা পেতাম তাই গ্রোগ্রাসে পাঠ করতাম কেবল জানার জন্য, নতুন নতুন চিন্তা, ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। জ্ঞানাকাঙ্ক্ষা ছিল প্রচ- তখনকার আমাদের উঠতি কবি ও লেখকদের মধ্যে। মেতেও ছিলাম পত্রিকা করার স্বপ্ননেশায়—সেই স্বপ্ন বার বার ভেঙ্গেছে। তাই জাপানে এসে প্রকাশ করেছিলাম ১৯৯১ সালেই ‘মানচিত্র’–যা আজকে ইতিহাস।

আমার কলেজজীবন মানেই ঘটনা আর আধুনিক গানের টালমাটাল সমুদ্র! ঘটনাগুলো সবই সেই বয়সের রাগ-অনুরাগ-ক্ষণপ্রেম-বিচ্ছেদ-বিরহজাত। এইসব সম্পর্কের কল্যাণেই আমি আবিষ্কার করি অপূর্ব আনন্দঘন এবং বিষাদঘন আধুনিক গানের এক পৃথিবীকে! এর আগে জানতামই না যে, বাংলা আধুনিক গান এত হৃদয়হন্তারক হয় কীভাবে? কোন্ মন্ত্রবলে? কোন্ প্রতিভার আগুনে জ্বলেপুড়ে? এমন কিছু গান শুনে মনে হত আরে! এই তো আমার জীবনের সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে! এ যে আমার অব্যক্ত অনুভূতিকেই বাইরে প্রকাশ করে দিচ্ছে! গানের কথা, সুর, বাদ্যযন্ত্র আর কণ্ঠের কারণে জলমগ্ন হয়ে থাকতাম। জলডুবিও হয়েছে মন মাঝেমাঝে বিচ্ছেদের আকস্মিকতায়! আমি নিজেও বেশ গাইতে পারতাম। বন্ধুদের অনুরোধে গাইতাম ছুটির দিনে কলেজের মাঠে, আর বৃষ্টির দিনে পাঠকক্ষে। ছুটির দিনেও পাঠকক্ষ খোলা থাকত। মান্না দে কিংবা মানবেন্দ্রর কঠিন গানও চলে আসতো আমার কণ্ঠে।

মনে পড়ে কোনো এক হৃদয়ঘটিত বিচ্ছেদের ঘটনায় আমি কিছুদিন খুব মুষড়ে পড়েছিলাম, উন্মাদ হয়ে পড়েছিলম প্রায়। সেইসময় মান্না দে’র ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’ আর মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ প্রায়সময়ই গুণগুণ করতাম। কলেজের সহপাঠী পাড়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানিক (অকাল প্রয়াত) পেছন থেকে টিপ্পনি কাটত: ওই দ্যাখো মরেছে! কিন্তু এত কঠিন গানও আমি সেইবয়সে গাইতে পারতাম অনায়াসে। নানা ঘটনা আমাকে গানপাগল বা গান-ক্রেজি করে তুলেছিল! রেয়ার, বহুশ্রুত নয় এমন অনেক গান আমি সংগ্রহ করেছিলাম। রেকর্ড এবং ক্যাসেট দুটোই। শিল্পীরা ছিলেন, সুবীর সেন, মৃণাল চক্রবর্তী, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, দ্বীজেন মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মুকেশ; শ্রিপা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতীহোম চৌধুরী, চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণপুর, গীতা দত্ত, সবিতা চৌধুরী, হৈমন্তী শুল্কা, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, ঊষা মুঙ্গেশকর প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সুবীর, মৃণাল, শৈলেন, দ্বীজেন, সুমন কল্যাণপুর, শিপ্রা বসু আর অরুন্ধতীর গান ছিল অসম্ভব-অসম্ভব প্রিয়! সেই বয়সে মনে হতো তাঁরা যেন আমার জীবনকথাকেই গানে তুলে ধরেছেন। এত একাত্মতা অনুভব করতাম।

জাপানে চলে আসার পর নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ, নতুন সংগ্রাম, নতুন স্বপ্ন এবং নতুন কর্মব্যস্ততা আমাকে বদলে দিয়েছিল আমূল। ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে আমার অন্যরকম এক জীবন গড়ে উঠেছে এই দেশে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অভূতপূর্ব মাধ্যম ‘ইউটিউবে’র কল্যাণে সেইসব বিস্মৃত গান আবার শুনতে পেয়ে জীবনগোলার তলায় সুপ্তথাকা স্মৃতিময় ঘটনাগুলো জানি না কোন্ সূর্যমন্ত্রে জেগে উঠছে! হৃদখাঁচার ভেতরে দাপাদাপি শুরু করেছে। এক ধরনের স্মৃতিভুক্ অস্থিরতা, রোমান্টিকতা আর নস্টালজিয়ায় হারিয়ে যাই আমি! বার বার ফিরে যাই ফেলে আসা দুরন্ত দুর্মর কলেজজীবনের দিনগুলোতে।

শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক