লেখালেখি ও শান্তির সমন্বয়

নার্গিস খান।।
যাপিত জীবনে জগত সংসারে তিষ্ঠ কালে আমরা শান্তি চাই। আমার দৃষ্টিতে শান্তি হলো দুটো বিষয়ের সমন্বয়। একটি মানুষের নিরাপত্তা অন্যটি মানসিক ভারসাম্য। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পিস অফ মাইন্ড ইজ এ মেন্টাল স্টেট অফ কামনেস। উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন শান্তির রূপ ,তদ্রূপ জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত খাদ্য এবং রিপ্রোডাকশন বা প্রজননের ব্যত্যয় ঘটানো হলে। এই দুটো অত্যাবশ্যকীয় চেতনায় নিহিত রয়েছে প্রত্যাশিত শান্তি।
কুঁড়েঘর থেকে অট্টালিকার পরে সকলেই শান্তি চায়। তাই তো কবি শহীদ কাদরী লিখেছিলেন, প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে ঠিকই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না ,পাবে না ……। আমাদের জীবনের ক্ষণিক সময়ের ব্যাপ্তিকালের সকল বিভ্রান্তিময় সময়ে আমরা শান্তি চাই। আমার সেই শান্তির ললিত বাণী আমি খুঁজে পাই, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাই, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় সন্তরণ করি আমার লেখক সত্তায়।
ছোটবেলা থেকেই ঘরে আব্বার পঠিত ও সংগৃহীত অজস্র বইয়ের ভান্ডার আমাকে প্রলুব্ধ করে বইয়ের অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করতে। মোহিত হতে। প্রথমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক ,পরবর্তীতে কর্পোরেট জগতের কর্মকর্তা আব্বা প্রায়ই তালিম দিতেন বাংলা সাহিত্যে খ্যাতনামা তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য কথার। আম্মা আমার ঘর কন্যার কাজে ফুরসত পেলে বইয়ের পাতায় নিবিষ্ট থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, গল্পগুচ্ছ, ডাক্তার লুৎফর রহমানের লেখক সমগ্র, ডেল কার্নেগীর সমাজ গঠনমূলক বই ,শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস, গৃহদাহ, শ্রীকান্তের কৃষ্ণকান্তের উইল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু ,চাঁদের অমাবস্যা, বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম ,সাহেব বিবি গোলাম, কাজী নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশি বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, তারাশঙ্করের কবি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি( যা পরবর্তীতে আমাদের একাদশ শ্রেণীর সহপাঠ ছিল) বুদ্ধদেব গুহের বই, মুনীর চৌধুরীর মুখরা রমণী ,শার্লক হোমস সমগ্র ,ম্যাক্সিম গোর্কির মা, লিও তলস্তয়ের ওয়ার এন্ড পিস ,হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি ইত্যাদি আমাকে কেবল আকৃষ্টই করেনি আমার লেখালেখির পথ চলার কৌশল রপ্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে। ছোটবেলায় যাপিত জীবনের আবহে উদ্ভট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছি। যেমন: আবশ্যকীয় পাঠ্য বইয়ের ভাঁজে গল্পের বই রেখে নিশ্চিত মনে পাহারাবিহীন ভাবে পড়াটাকে আবশ্যিকীয় থেকে আরো আবশ্যকীয় করে তুলেছিল। এই আবশ্যকীয়তা গেঁথে যায় মনে একনিষ্ঠতায়। শিক্ষানবিশ এর নিয়মিত চর্চায় এই ছন্দপতন ঘটাতো অহরহ আর ছোটবেলার লেখক হিরু হুমায়ূন আহমেদের এই সৃষ্টিশীলতা আমার ছন্দপতনকে আরো তরঙ্গায়িত করত কয়েক ধাপ এগিয়ে। আমার অবাধ্য, অপ্রতিরোধ্য কিশোরী মনকে আন্দোলিত করতো ,মোহনীয় করে তুলতো। সমাজের দৃশ্যমান ও ঘটমান জীবন বোধের সহজ সরল উপস্থাপনা, কাঙ্খিত কামনায় সন্ধান বোধ করি এই অধম আমি ছাড়া অন্যদের ছন্দেও তিনি দোলা দেন। তার নীতিবোধকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অনুভবি লেখনি ঢংয়ের নিষ্ঠায়। মনে মনে আওড়াই স্বপ্ন আঁকি বড় সাহিত্যিক হবো, লেখক হবো ,সমাজের উন্নয়ন ঘটাবো ,বিপ্লব ঘটাবো। যদিও পরবর্তীতে চিন্তার স্ফুরণে বাধ সাধে।

আমার অন্তরালের সাহিত্যিক জীবনের শুরু ৩৬ বছর আগে। ভুলে ভরা জীবন আমার। আবেগে পরিপূর্ণ লেখকদের কোন জাত পাত নেই, আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। আবেগীয় উপাদান, অদৃশ্য উপলব্ধির প্রেষণা ,হৃদয়ের অনুভূতি গুলো সূর্যের দিবা আলোর মতো সৃষ্টি করে লেখক। সৃষ্টির অন্বেষণ রোজগারের তাগিদে ছাপিয়ে যায় । কখনো কখনো সৃষ্টি চক্র আবর্তিত হয় সমাজের জন্য, মানব কল্যাণের জন্য, অবহেলা, লাঞ্ছনা,ব্যর্থতা অবলুপ্তির জন্য। সর্বোপরি নব আবিষ্কারের জন্য।
আমার অনুভবগুলো প্রকাশ করবো সরলতার অবয়বে। বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামগুলো কি কি যখন আব্বা প্রশ্ন ছুড়তেন সাহিত্যের রসবোধ বেশ উপভোগ্যই মনে হতো। আনন্দ স্ফুলিঙ্গের আলিঙ্গনের তপ্ততায় সাধ বৃদ্ধি করে জগত সংসারের বিনিময় অদৃশ্য হয়ে যায়। অবিকৃত আত্মা সমাজ বিপ্লবের জন্য উদিত হয়। তেমনি আমার ইন্দ্রিয় অন্বেষণ করে রিয়েলিটির। অন্যরকম সংস্কৃতির বহতা নদীর সমন্বয়ে ঘটে আমার মানস পটে। সৃষ্টির ত্যাগ আমাতে আগুন ধরায়ে দেয়।
আমি স্বাধীন চেতা, সৃষ্টিশীল চেতনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি উপন্যাস পড়ি, গল্প করি, আত্মজীবনী পড়ি লোকসংস্কৃতি মনোযোগ দিয়ে পড়ি আর গভীর মনোযোগ দেই ইতিহাস ও ধর্মীয় গ্রন্থের শেকড়ে।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের পাদ পিঠে প্রবেশ কালীন সময়ে প্রিয় বান্ধবীর প্রমোদ গুণায় বারবার পড়েছি বুদ্ধদেব গুহের “বাবলি” বইটি। একটি নির্ঝঞ্ঝাট সহজ সরল প্রেমের বই। আজও তা বিশ্বাসের অন্ধত্বকে ছাড়িয়ে মনে ভ্রান্তিবিলাসের বিদ্রোহ ঘটাচ্ছে।
একজন লেখকের লেখনী নিঃসৃত কথাগুলো পরিস্ফুটিত হয় সমাজের দর্পণ স্বরূপ। অভ্যাসবশত: ইচ্ছায় আনন্দ পরিপূর্ণ করে তুলে। লেখক নর-নারীরা এই ভাবেই তো শ্বাশ^ত প্রেমের সন্ধান করে ,অন্বেষণে মুখিয়ে পড়ে । জ্ঞানহীন দৃষ্টতাকে পরিহার করে। শকুন্তলাকে উপেক্ষা করে রাজ সিংহাসনের অভিজ্ঞতার আস্থা বলে। যদিও বিষয়ভিত্তিক পড়ার কোন উপায়ান্তর থাকে না। বিজ্ঞান চেতনা শিল্পী মনাকে আড়ষ্ট করে জীবনের ফুল ফোটায়, সাহিত্য সৃষ্টি করে যাকে ঢাল তলোয়ারবিহীন ইনভেনশন বলা হয়। নব আবিষ্কার কোন খামখেয়ালি বিষয় নয় ।নিজস্বতা,আত্মনিয়োগ একজন সাহিত্যিককে বলিয়ান করে তোলে,পূর্ণতা দেয়। এই ক্ষেত্রে সে সাহিত্যের অন্তর্যামী রূপে আবর্তিত হয়। আত্মার আত্মীয় আর প্রাকৃত রূপে তৃপ্ত হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে প্রধান অবলম্বন করে জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায়। লেখক সত্তার সৃষ্টিশীল বহ্নি কুশলী চালকের ভূমিকায় পর্যবসিত হয়। আপন অভিজ্ঞতার রূপ রসের বিচারে পাঠককে জীবন বোধের সারিতে দাঁড় করায়।
একজন লেখক তার ভুবনে সেই রাজা। তার অন্তরে ঘটে যাওয়া রাজ্যের অন্বেষণে সমৃদ্ধ। ঐ রাজ্যে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না, অনুভূতির সাথে তার কল্পনার মিশ্রণ ঘটে। যেন প্রভাতের অগ্নিচ্ছটায় দিগ্ দিগন্ত উদ্ভাসিত হচ্ছে। মুঢ়তা, গ্লানি , ক্লেদ প্রশমিত হচ্ছে। একজন লেখক এর প্রাণ উচ্ছলতার প্রত্যয় বহন করে নতুনের প্রতিচ্ছবি। দহন কাল পেরিয়ে আবিষ্কৃত হয় উদারতার। রুদ্র উদ্দীপ্ত আহ্বান , আত্মিক শুদ্ধির অভিযান সংকেত দেয় পুনর্জাগরণের । অস্থিরতা আর সামাজিক বিভাজনকে দূরে ঠেলে দেয়। ঐক্যের আয়োজন করতে শেখায়। মহাসাগরের স্রোত আর সূর্যের তাপের বিশালতায় প্রাত্যহিক জীবনের দোলা দেয়।
আমি মনে করি আমিই একটি পৃথিবী। তেমনি প্রতিটি মানুষ এক একটি পৃথিবী। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এক একটি উপন্যাস । এই অভিজ্ঞতার বিস্ফোরণ ঘটে ফসলের মাঠ থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার পর্যন্ত। আমি আমার অন্তরে তা পোষণ করি, রোজগারের অন্বেষণ আমার লেখক সত্তার অন্বেষাকে কখনো বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে না। লেখালেখির উচ্চাভিলাস আমাকে তাড়িত করে এই বিশ্বাসই দৃঢ় এবং চূড়ান্ত শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত।
লেখক:অধ্যক্ষ, লেখক ও সংগঠক।