সম্পাদকীয়; রফিক এখন ‘বীজ সুলতান’

 

‘গনি মিয়া একজন কৃষক। তার নিজের কোন জমি নেই। তিনি অন্যের জমি বর্গা চাষ করেন।’ শৈশবের সেই গল্পের মতোই কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রফিক আহমেদের জীবন। তবে তিনি ঋণ করে ঘি খান না। তিনি বীজ উৎপাদন করে অন্যের খাবারের যোগান দেন। বছরে হাজারো কৃষককে বীজ সরবরাহ করেন। এনিয়ে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

সংবাদে উল্লেখ করা হয়, রফিক আহমেদের জন্মস্থান ফেনী সদরে। বয়স ৬০এর কোটায়। ১৯৭৮সালের কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার একটি জুট মিলে কাজ নেন। ৮৪সালে কুয়েত যান। ৯০সালে দেশে আসেন। পরিকল্পনা ছিলো দেশে পাঠানো টাকায় ব্যবসা করবেন। সেই টাকা গুলো পারিবারিক কারণে হাতছাড়া হয়ে যায়। জমানো টাকা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। আবার চলে আসেন চান্দিনা এলাকায়। দিন মজুরের কাজ নেন। খেয়ে না খেয়ে থাকেন। ঘরে ৫সন্তান ও স্ত্রী। ২০০৮সালে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক উপ-সহকারী কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের সাথে দেখা হয়। তার পরামর্শে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ শুরু করেন। নিজে ও সন্তানরা জমিতে স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বাড়িতে পরিশ্রম করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাদের ভাতের কষ্ট কমতে থাকে। আশপাশের এলাকায় ভালো বীজের সংকট দেখে তিনি বীজ রাখতে শুরু করেন। তাকে উৎসাহ দেন কৃষি অফিস। চান্দিনা সংলগ্ন দেবিদ্বার উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের কাবিলপুর গ্রামে আড়াই শতক জমি কিনেন। সেখানে একটি টিনের ঘর করে পরিবার নিয়ে থাকেন। এদিকে তার বীজের চাহিদা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি ৫একর জমি বর্গা নেন। তিনি ব্রি ধান ৪৮,৯৮,৭১,৯২, ৯৫,৯৬,১০৩ সহ বিভিন্ন নতুন প্রজাতির ধানের বীজ সম্প্রসারণে কাজ করছেন। মানে ভালো ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় দেবিদ্বার,চান্দিনা ও মুরাদনগর,দাউদকান্দি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তার থেকে বীজ নেন। তিনি সবার কাছে হয়ে উঠেছেন সুলতানপুর ইউনিয়নের ‘বীজ সুলতান’।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়,ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হর্ন বাজিয়ে গতিতে ছুটছে নানা পরিবহন। দুই লেনের মাঝে ধানের জমি। দেবিদ্বার উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের জমিতে ধান কাটছেন শ্রমিকরা, সেখানে রফিক আহমেদও নেমে পড়েন। তারপর আসেন বীজতলায়, পানি জমেছে সেটা গামলা দিয়ে নিষ্কাশন করেন। এটা শেষ করে কোদাল দিয়ে আইল কাটছেন ধানের জমির পানি সরাতে। প্রতিবেশীর ছাদে ধান শুকাতে দিয়েছেন। সেটা রেখে ধান মাড়াই তদারকি করছেন। ক্রেতার ডাক পড়ায় বাড়িতে হাঁটা দেন। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীসহ বীজ ধান মেপে দিচ্ছেন। এতো পরিশ্রমের পরেও তাকে ক্লান্তি ছুঁতে পারে না, তার মুখে ঝুলে থাকে এক ফালি হাসি।

রফিক আহমেদ বলেন,এক সময় ভাতের খুব কষ্ট পেয়েছেন, তাই ধান চাষে আসেন। এরপর বীজ উৎপাদন শুরু করেন। গত আউশ মৌসুমে ২টন,আমন মৌসুমে ১টন ও বোরো মৌসুমে তিন টন বীজ বিক্রি করেন। বীজ বিক্রি করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে ভালো আছেন। আড়াই শতক বাড়ির উঠানে জায়গা কম, তাই বীজ মানুষের বাড়িতেও রাখতে হয়। একটি সেচ পাম্প বসিয়েছেন,তবে নিজের বিদ্যুতের মিটার নেই, পাশের মসজিদের মিটার ব্যবহার করেন। এতে তাদের বিলও তাকে দিতে হয়।

রফিক আহমেদের স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বলেন,তার স্বামী জমির ফসলকে সন্তানের মতো যতœ করেন। রাত পোহালেই জমিতে গিয়ে নামেন। আমরা দুইজনে মিলে ধানের বীজ রাখি। মানুষ যখন বলে ভালো ধান হয়েছে, তখন মনটা খুশিতে ভরে যায়।

 

কুরছাপ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম বলেন,১৫বছর ধরে এই এলাকায় বীজ উৎপাদন করছেন রফিক আহমেদ। তার বীজে ভেজাল নেই, তাই আমরা ভালো ফসল পাচ্ছি।

কাবিলপুর গ্রামের মিনোয়ারা বেগম ও ফাহিমা বেগম বলেন, কম দামে তার থেকে বীজ পাই। কখনও টাকা ছাড়াও বীজ দেন। কখন জমিতে সার ও বালাই নাশক দিতে হবে সেই পরামর্শও তার থেকে নিই।

 

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ভালো মানের বীজ উৎপাদনের জন্য ভালো উদ্যোক্তা প্রয়োজন। রফিক একজন সংগ্রামী মানুষ। তার নিজের জমি নেই। নেই বিদ্যুতের মিটার। এমন উদ্যোক্তাকে এগিয়ে দিলে দেশের কৃষি এগিয়ে যাবে। তার প্রয়োজন মেটানোর বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।