স্যার, আমায় মাফ করে দিয়েন–  এইচ.এম. সিরাজ 

প্রফেসর মো. আবুল হাসান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ, যেনো একটাই প্রতিষ্ঠান। সেই ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সাংবাদিকতাকে বৃত্তি হিসেবে নেবার পর যে কয়জনকে অকৃত্রিম পরামর্শক হিসেবে পেয়েছিলাম, হাসান স্যার তাদের একজন নয়, অন্যতমও। পেশাগত এ জীবনে বহু সংবাদ লিখেছি। ইদানিংকালে অসংখ্য শোক সংবাদ পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকে লিখেছি। তাই বলে হাসান স্যারের শোক সংবাদ লিখতে হবে? আমি পারবো না, আমার কলম দিয়ে কোনো লিখা আসবে না। স্যার, এই হতভাগাটাকে মাফ করে দিয়েন।
সেই ৯০ দশকের গোড়ার দিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে পড়াকালে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছিলাম আমরা ক’জন। এই বিষয়ে কি এক তালিকা প্রস্তুতের দায়িত্ব বর্তায় আমার স্কন্ধে। তালিকাটা প্রায় সম্পন্ন করে দু’তলাস্থ শিক্ষক মিলনায়তনে যাই হাসান স্যারকে দেখাতে। তালিকাটি হাতে নিয়েই বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, ‘এটা কি লিখলে? একজনের নামের বানানটাও ভুল লিখলে কীভাবে? মানুষের নাম ভুল লিখলে, আর নামের মানুষটা সেই ভুলটি দেখলে কতোটা কষ্ট পায় জানো?’ স্যার, এমনটি আর হবেনা এমন ওয়াদার পর সেই প্রচণ্ড রাগী মানুষটি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার সময় অবাকই হলাম। সেইদিন থেকেই আমি স্যারের পরিচিত থেকে আরো পরিচিত-অনুরক্ত-স্নেহধন্য। তবে একটি কথা না বললেই নয়, সেই থেকে আজ অবধি কোনো মানুষের নাম আমি ভুলভাবে লিখতে পারিনা, কেউ ভুল লিখলে তা সহ্যও করতে পারিনা। এটাই আমার উপর সার্ভাইভ হওয়া হাসান স্যারের আদর্শ।
স্যারের সঙ্গে আমার খুব সখ্যতা ছিলো। স্যার আমাকে খুব আদর-স্নেহ করতেন।তবে কেন করতেন সেটি ঠিক জানি না। যদ্দূর বুঝেছি, তা হচ্ছে গুছিয়ে লিখার জন্য। প্রায়শই বলতেন, ‘তোমার সাংবাদিকতায় সাহিত্যের সংমিশ্রণ পাই, যেটা বেশ কষ্টসাধ্য।‘ একটি কথা স্যার বহুবার বলেছেন, ‘যেদিন থেকে জানলাম তুমি কুমিল্লার আমোদ পত্রিকায় কাজ করো, সেদিন থেকে তোমায় আরো বেশি আদর করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমোদ পত্রিকা মানুষকে ভালো শিক্ষা দেয়।’ সে যাইহোক, স্যার মাঝে মাঝে খোঁজ নিতেন। আমার করা ভালো কোনো প্রতিবেদন, উপসম্পাদকীয় টাইপ লেখা স্যারের চোখে পড়লেই স্যার ফোন করতেন। বলতেন,বিষয়টি পড়েছি- ভালো হয়েছে।’ কদাচ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে হাসান স্যার নানান কিছু পাঠাতেন। প্রায়শই এটা ওটা নিয়ে নিউজ করতেও বলতেন। ‘প্রবাহ’ নামীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের তৃতীয় প্রকাশনায় স্যার স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখায় এই আমাকে এতোটা সম্মানিত করেছেন, যেটি হাসান স্যারের দ্বারাতেই সম্ভব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন বড় মাপের শিক্ষাবিদ হাসান স্যার। কেবল ছাত্রই নয়, অসংখ্য শিক্ষাবিদের শিক্ষক, জেলাবাসীর প্রিয় ব্যক্তিত্ব, শ্রদ্ধাভাজন একজন আদর্শ মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আলহাজ্ব মো. আবুল হাসান। এমন ব্যতিক্রমী মানুষ সমাজে সত্যিই বিরল। হাসান স্যারের বদান্যতায় এযাবতকালে অনেক গুণী মানুষের সাহচর্য পেয়েছি-পাচ্ছি, সেসব বলে শেষ করার নয়। এইতো সেদিন, ১১ ডিসেম্বর আচমকা ফোন করেন স্যার। বললেন তাঁর এক প্রিয় ছাত্রের কথা, যিনি আমেরিকায় প্রবাসী একজন লেখক। বললেন, ‘রানাকে (সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইমাম রানা) নিয়ে ওর (মো. সাইদুল হক নিপু) লেখাটা তোমার কাগজে ছেপে দিও। স্যারের অনুরোধকে আদেশ গণ্যে পালন করায় স্যার সে কি খুশি, বলাই বাহুল্য। স্যার এই বিষয়টি ওই লেখককে জানিয়ে আমার মোবাইল নাম্বারও সরবরাহ করলেন। খানিকটা সময় পরই সুদূর মার্কিন মুল্লুকে অবস্থানকারী সেই মানুষটা ফোন করে আমায় ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি হাসান স্যারের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে অনেক বাড়িয়ে বলা কথা বললেন। আর এতে করে ‘আমি হাসান স্যারের এতোটা আদরের কিভাবে হলাম!’ ভেবে নিজেকে গর্বিতই মনে হলো।
হাসান স্যার ঢাকাস্থ নিজ ভবনে ১৭ ডিসেম্বর’২০ সকাল নয়টার দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন, ইন্নাল্লিাহি———–রাজিউন। বৃহস্পতিবার বাদ আসর নামাজে জানাজা শেষে ঢাকাতেই স্যারকে সমাহিত করা হয়। না ফেরার দেশে চলে গেলেন হাসান স্যার। বৃহস্পতিবার সকালে স্যারের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার সংবাদটি প্রথম আমেরিকা প্রবাসী স্যারের প্রিয় ছাত্র সাইদুল হক নিপু ভাই থেকে শুনে আতকে উঠেছি। তিনি বললেন, ‘আপনি কি কিছু শুনেছেন? মনটাকে একটু শক্ত করুন। আমি বিশ্বাস করি আপনি হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না। হাসান স্যার—-!’ আসলেই নিজেকে সামলাতে পারিনি, তৎক্ষনাতই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেছি। বিগত দু’বছর আগে বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেও এতোটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম বলে মনে হয়নি। হাসান স্যার নেই শব্দটি কর্ণকুহরে প্রবেশান্তে মনে হয়েছে, যেনো আজকে আমি এতিম হয়ে গেলাম!
হাসান স্যার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন। স্যার খুব দ্রুতই চলে গেলেন। আর কেউ এসে বলবে না, হাসান স্যার তোমার খোঁজ নিয়েছে। তোমাকে এই নিউজটি করতে বলেছে। স্যার আর আপনার ফোন আসবে না। আর শোনা হবেনা, সিরাজ লেখাটা ভালো হয়েছে। এসব খুব খুব মিস করবো স্যার। এই ত্রিভূবনের মালিক, মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামিনের কাছে  দুই হাত  তুলে মোনজাত করি, আল্লাহ্ যেন আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ আসনে রাখেন। স্যারের মাগফেরাতে জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি। আল্লাহ্ স্যারের পরিবারকে এই শোক সহ্য করার মতো তৌফিক দান করুক, আমীন।



এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।