৩৪ শহীদের স্বজনদের খবর কেউ রাখেনি

 

১৯৭১সালের অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাপিতলা গ্রাম। বাড়ির উঠানে,পুকুর পাড়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ। কেউ নেই লাশ দাফন করার। লাশ শিয়াল কুকুরে খেয়েছে। ছয় সাত দিন পরে এসে বাবা,ভাইয়ের আধ খাওয়া লাশটা দাফন করা হয়েছে। তাও ঠিক ধর্মীয় মতের দাফন নয়। গোসল জানাযা নেই। খাটিয়া যোগে কাঁধে করে লাশ দোয়া কালাম পড়ে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য তাদের হয়নি।

কাউকে স্ত্রীর পুরাতন কাপড় বা ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে পুরাতন ভাঙ্গা কবরের গর্তে ঠেসে দেয়া হয়েছে। যারা লাশের সৎকারে গেছেন তাদেরও তো জীবনের মায়া ছিলো। যদি আবার পাকিস্থানী কিংবা রাজাকার বাহিনী ফিরে আসে। যদি তাদের হাতে ধরা পড়ে। এই ভয় তাদের তাড়া করে ফিরেছে। এর থেকে বেশি নৃশংসতার বর্ণনা দিয়েছেন চাপিতলা গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী,মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা। লাশের সংখ্যা ৩২ না ৩৪। তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের বর্বরতা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ৩১ অক্টোবর সকালের তাণ্ডবে শহীদ হন ৩৪জন। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

 

সংবাদে উল্লেখ করা হয়, শহীদ পরিবারের সদস্য অমূল্য চন্দ্র দেবনাথ বলেন,পিতা পেয়ারী মোহন দেবনাথ, জেঠা অলঙ্গ মোহন দেবনাথ, চাচা সূর্য মোহন দেবনাথ। তাদের তিনজনকেই রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মেরে ফেলে। যুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে তিনি ভারতে চলে যান। কিন্তু তার বাবা যেতে চাননি। তিনি বলেছেন-মরলে নিজের ভিটায় মরবো। তাকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে। বাবার লাশ দাহ করা যায়নি। শিয়াল কুকুরে খেয়েছে। তিনি দেশে এসে বাবার মাথার খুলিটা পেয়েছেন। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। তাঁতের কাজ করে পরিবার চালিয়েছেন। তিনি একজন পঙ্গু মানুষ। ডায়াবেটিসে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। যুদ্ধের পরে এক বান্ডিল টিন ও দুই হাজার টাকা সহযোগিতা পেয়েছিলেন। আর তাদের কেউ খবর রাখেনি।

শহীদের আরেক স্বজন মোরশেদ আলম ভুইয়া বলেন,মুক্তিযুদ্ধে তার ভাই মনিরুল হক ভুইয়া শহীদ হন। মুক্তি বাহিনী তাদের বাড়িতে বাংকার করে। তিনিসহ মাটি কেটে বাংকার করেন। তাই পাকিস্থানী বাহিনী তাদের বাড়ির উপর ক্ষুব্ধ হয়। হানাদার বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি তার ভাইয়ের হাতে পড়ে। তিনি হাত বেঁধে কুচুরিপানার পুকুরে লুকিয়ে থাকেন। হানাদার বাহিনী কাছাকাছি এসে গেলে পুকুর থেকে উঠে দৌড়াতে শুরু করেন। এবার তার পায়ে গুলি করা হয়। তার পা ভেঙ্গে যায়। তিনি লুটিয়ে পড়ে যান। এসময় হানাদার বাহিনী এসে তাকে বুট দিয়ে পাড়াতে থাকেন। এক সময় নাভীর দুই ইঞ্চি ডানে বেয়নেট দিয়ে তার পেটটা চিরে ফেলে। তাদের গুলির আওয়াজে এই এলাকার গাছে কোন পাখি ছিলো না।
আরেকজন স্বজন সাইদুর রহমান বলেন, একইদিন তার বাবা সুলতান আহমেদ,বড় ভাই হারুনুর রশিদ ও চাচা সুন্দর আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

লাশ গুলো ঠিক মতো দাফন করতে পারেননি। এক সপ্তাহ পর্যন্ত শিয়াল কুকুরে খেয়েছে। পরে ওই পুকুর পাড়ে এক কবরে দুই তিনজনকে মাটি চাপা দিয়েছে।

 

সদ্য প্রয়াত চাপিতলা এলাকার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন অ্যাভোকেট সামছুল হক ফিরোজ। তিনি বলেন, এই গ্রামে দুইজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন-তার হলেন মাজেদ ভুইয়া ও হালিম ভুইয়া। তাদের মাধ্যমে এলাকায় অত্যাচার বেশি হতো। আমাদের টার্গেট ছিলো হিট এন্ড রান। আঘাত করে পালাও। আমরা পাকিস্তানীদের পঙ্গু করে দিয়েছিলাম। তারা গাছের পাখিকেও ভয় পেতো। পাখি ডাকলে মনে করতো মুক্তি বাহিনী। আগে কত শকুন ছিলো। এখন নেই কেনো। পাকিস্তানীরা মেরে ফেলেছে। আমাদের এলাকায় ১৪শত সদস্যের পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যেও প্রতিরোধ করেছি ৮৪জনকে নিয়ে। ৩১অক্টোবর গ্রামের মানুষ গুলো মারা যাওয়ার পর,বাড়ি-ঘর পুড়ে দেওয়ায় পর পরিবার নাম মাত্র কিছু টিন ও দুই হাজার টাকা করে পেয়েছিলো। স্বাধীনতার এতো পরেও শহীদ পরিবার গুলো কোনো সহযোগিতা পায়নি।

 

মুক্তিযুদ্ধকালীন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, চাপিতলার বাসিন্দা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, চাপিতলা এলাকায় ছয় প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। তাদের জন্য গ্রামের মানুষ থেকে চাঁদা তুলে খাবার সংগ্রহ করেন। ৩১অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চাপিতলায় গণহত্যা,নির্যাতন,অগ্নিসংযোগ ও গণ ধর্ষণের ঘটনা শুরু হয়। এসময় ৩৪জন মানুষ মারা যায়। ১১জন নারী ধর্ষিত হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে ২নভেম্বর পর্যন্ত এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ সৃষ্টি হয়। এতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৯জন রাজাকার ও ৯৭জন পাকিস্তানী নিহত হয়। ১৯৭২সালের ২১এপ্রিল তিনি ২২জন রাজাকারের বিরুদ্ধে মুরাদনগর থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন। শহীদরা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সহযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাননি। দেশ স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও শহীদদেও স্মরণে কোন স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। শহীদের পরিবার গুলোরও আজ পর্যন্ত কেউ খবর নেয়নি।

মুুরাদনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ বলেন,চাপিতলার শহীদদের বিষয়টি খোঁজ নেবো। স্বজনদের সহযোগিতা ও স্মৃতি রক্ষার জন্য আমরা কাজ করবো।

আমরা চাই শহীদদের স্বজনদের সরকার মূল্যায়ন করুক। যাদের অর্থকষ্ট রয়েছে তাদের পাশে দাঁড়াক। সেখানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হোক।