শুভ জন্মদিন কুমিল্লা জিলা স্কুল– পিয়াস মজিদ
বাংলা সঙ্গীত ভুবনের কিংবদন্তি শচীন দেববর্মণ কুমিল্লা জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯২০ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯১৬ সালে বাবা নবদ্বীপ কর্তার শেখানো গান স্কুলের সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে গেয়ে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশংসাও পেয়েছেন। উত্তরকালে সঙ্গীতের সুধা দিয়ে তিনি আমাদের মাঝে মুগ্ধতার যে আবেশ ছড়ান, তার বীজ বুনেছিল কুমিল্লা জিলা স্কুলের উর্বর প্রান্তর। তার বাল্যের প্রিয় কুমিল্লা জিলা স্কুলকে স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল রেখেছেন এভাবে- স্কুলের সঙ্গেই লাগোয়া খেলার মাঠ ও তার পাশে বুড়ো বটগাছ। সেই গাছের নিচে আমাদের গানের নিয়মিত আসর জমত টিফিনের ছুটিতে। …গাইতাম- খোলা মাঠে- পাশে ধর্মসাগর দীঘি- বড় বড় গাছের তলায়, রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, বাদলে, শীতে, কী আনন্দই না পেয়েছি প্রকৃতির কোলে মাটির গান গেয়ে দিন কাটিয়ে।
(সূত্র :শচীন কর্তার জীবন ও গান, শ্যামল চক্রবর্তী, ২০০১)
শিক্ষানুরাগী হেনরি জর্জ লেসিস্টার (১৮০৮-১৮৭০) কুমিল্লা ধর্মসাগর দীঘির পূর্বপাড়ের দক্ষিণাংশে একটি বাংলো ঘরে জনা চল্লিশ ছাত্র নিয়ে ১৮৩৭-এর ২০ জুলাই যে কুমিল্লা জিলা স্কুলের (প্রথম নাম ‘কুমিল্লা গভর্নমেন্ট স্কুল’) প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তার ছাত্রসংখ্যা এখন দু’হাজার ছাড়িয়েছে। ভাষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর একে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। ১৮৫৪-তে এই বালক বিদ্যালয়টি জনশিক্ষা দপ্তরের আওতায় আসে এবং ১৮৫৭-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। জিলা স্কুল গড়ে ওঠার ব্যবস্থাপনায় সর্বধর্মীয় বিদ্যানুরাগীদের সমাবেশ ঘটেছিল, যা এই অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যেরই পরিচয়বহ। এই স্কুলের ছাত্ররা বৃত্তি লাভ করত যুগপৎ ত্রিপুরার মহারাজার তহবিল এবং মুহসীন ফান্ড থেকে।
এখন পর্যন্ত জিলা স্কুলের অর্ধশতাধিক প্রধান শিক্ষকের মধ্যে স্মরণীয় একজন ছিলেন তৎকালীন কুমিল্লা শহরে হিন্দু-মুসলিম মিলনের বার্তাবাহক- দ্বিজদাস দত্ত। ১৮৮০-র এপ্রিল থেকে বছরখানেক কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী দ্বিজদাস দত্ত রচনা করেছিলেন ঋজ্ঞ্বেদ, বৈদিক বর্ণ বা জাতিতত্ত্ব, বেদের সূত্রসংগ্রহ এবং কোরআনের সুরার মতো অসামান্য কিছু গ্রন্থ। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাসাদ্দুক লোহানীর মতো বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও লেখক, যিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত ‘লোহানী’ পরিবারের সন্তান।
শচীন দেববর্মণ ছাড়াও এ স্কুলের আরও কয়েকজন কৃতী ছাত্রের মধ্যে ছিলেন- ছন্দগুরু প্রবোধচন্দ্র সেন, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, গীতিকার সুবোধ পুরকায়স্থ, ব্রিটিশবিরোধী যুগান্তর দলের সদস্য সুধীর ব্রহ্ম, উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজের নেতা কৈলাসচন্দ্র নন্দী, বিহারীলাল সেন, প্রখ্যাত ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ববিদ এবং ত্রিপুরার ইতিহাসখ্যাত রাজমালা গ্রন্থের লেখক কৈলাসচন্দ্র সিংহ, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ নামে খ্যাতনামা বইয়ের লেখক রেবতীমোহন বর্মণ, দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সাহিত্যিক মোবাশ্বের আলী, ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ পরিমল দত্ত, নজরুলসঙ্গীতজ্ঞ সুধীন দাশ, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আপেল মাহমুদ, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার শিবনারায়ণ দাশ, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের স্থপতি হালী মোস্তফা, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া, ক্রিকেটার এনামুল হক মনি, সঙ্গীতশিল্পী আসিফ আকবরসহ অনেকে।
প্রতিষ্ঠার দিক থেকে দেশের প্রথম দশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম এ স্টু্কলের ছাত্ররা তাদের মেধা ও শ্রমের মধ্য দিয়ে স্কুলকে যুগ যুগ ধরে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব এনে দেয়নি শুধু, একই সঙ্গে আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, বিতর্ক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞানচর্চায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রেখে চলেছে সাফল্যের স্বর্ণস্বাক্ষর। কুমিল্লা জিলা স্কুলের স্কাউট গ্রুপের ইতিহাসও প্রায় শত বছরের। পরীক্ষার ফলের মানের পাশাপাশি মননের চর্চাতে ছাত্ররা পালন করে আসছে অগ্রণী ভূমিকা। তাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক দুর্যোগে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে উদাত্ত চিত্তে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে এ স্কুলের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এ স্কুলের ছাত্র আবু জাহিদ। ছাত্রাবস্থায় এ স্কুলেরই ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসান পাখীর নেতৃত্বে কসবার চারগাছে ১৯৭১-এর ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে সম্মুখসমরে অংশগ্রহণকালে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। একজন নবম শ্রেণির কিশোরকে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছে কুমিল্লা জিলা স্কুলের উদার পরিবেশের দেশপ্রেমের বাণী। বীর এই ছাত্রের স্মৃতিতে স্কুলের মিলনায়তনের নাম হয়েছে শহীদ আবু জাহিদ মিলনায়তন। নাজমুল হাসান পাখীর তথ্য অনুযায়ী, এ স্কুলের ১৩৮ জন ছাত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, যা স্কুলের গৌরবে যোগ করেছে উজ্জ্বল পালক। স্কুলের আরও তিন প্রাক্তন ছাত্র- খন্দকার আবু তাহের, একেএম মোজাম্মেল হক, একেএম শাহনাজ হায়দার মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে পঙ্গুত্ববরণ করেন প্রাক্তন ছাত্র জাকির হোসেন, যিনি একাত্তরের এপ্রিলে যশোর জেলভাঙার নেতৃত্ব দিয়ে কারাবন্দিদের মুক্ত করার দুঃসাহসী পর্বে অংশ নিয়েছেন।
২০২০-র ২০ জুলাই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক কুমিল্লা জিলা স্কুল তার প্রতিষ্ঠার ১৮৩ বছর পূর্ণ করল। প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ জ্ঞানের অনির্বাণ আলোকশিখা ছড়িয়ে যাওয়া এই বিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধু তার নিজের ইতিহাসই নয়, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা-ইতিহাসেরও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। দ্বিশতবর্ষের দিকে কুমিল্লা জিলা স্কুলের অভিযাত্রা শুভ হোক; শুভ জন্মদিন কুমিল্লা জিলা স্কুল।
পিয়াস মজিদ, কুমিল্লা জিলা স্কুলের ২০০০ ব্যাচের শিক্ষার্থী