নতুন জামা দেহাইলে ঈদ অইত না
।।মো.মহিউদ্দিন আকাশ।।
আইজ্জা রোজা ১৮ টা (আজকে ১৮ তম রোজা চলছে) আর দুইদিন পর মাদ্রাসা বন্ধ দিবে। বাড়ি যাব। পরিবার পরিজন বাড়ির বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। ওয়াও কি মজা। একদিকে যেমন আনন্দ অন্যদিকে কিছুটা কষ্টও এখানকার বন্ধুরা প্রত্যেকে তাদের বাড়ি চলে যাবে। আর দেখা হবে ঈদের পরে।
বিকেলে বন্ধুরা মিলে গেলাম কালিয়ারচর বাজারে, যেখানে নানান সাজে সজ্জিত ঈদ কার্ড। ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত একেকটা ঈদ কার্ডের দাম। ভিতরে লিখা নানান ছন্দ। আমরা ঈদ কার্ড কিনে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে দিতাম। আর সেদিন থেকেই আমাদের মনে দোলা দিত ঈদের আনন্দ।
ঈদ অর্থ কি? ঈদের ফজিলত কি? তা সঠিকভাবে না জানলেও মনের মাঝে আনন্দ বিরাজ করত। কৈশোর মন যেন উড়ে বেড়ায় আনন্দের দোলনায়।
২০ রমজান মাদ্রাসা বন্ধ দেয়া হলে সবাই ব্যাগ ঘুছিয়ে রওয়ানা হতাম সবার বাড়ির দিকে। কাঁধের ব্যাগে জায়গা থাকলেও বন্ধুদের দেয়া ঈদ কার্ডটা সবার হাতেই থাকত।
ঈদ কার্ডের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কত যে গল্প লিখতাম তার ইয়াত্তা নেই। কার্ড নিয়ে বাড়ির বন্ধুদের দেখাব আমার শহরের বন্ধু উপহার দিয়েছে। এত সুন্দর জিনিস তারা প্রথম দেখবে, গাঁয়ের সব বন্ধুরা আমার এ কার্ড দেখতে আসবে। কি যে আনন্দ!
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছি। রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয়। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ঈদ কার্ড নিয়ে হাঁটছি বাড়ির সামনে যেতেই আরেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী চাচাত বোন আয়শার সাথে দেখা।
তোর হাতে এটা কি বলেই কার্ডটা নিয়ে যায় সে। অনেক তর্ক বিতর্ক করেও কার্ডটি আর ফিরে পাইনি। তাই কাদঁতে কাদঁতে বাড়িতে প্রবেশ।
কিরে বাবা! কান্দোছ ক্যা? মায়ের সহজ সরল প্রশ্ন। ”ঐ বাড়ির আয়শায় আমার ঈদ কার্ড লইয়া গেছেগা” বলেই কান্না। বাবা এসে নতুন পাঞ্জাবি কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাজারে নিয়ে গেলেন।
সে সময়ে বাজারে যেতে পারা ছিল বাড়তি আনন্দ। বাজার থেকে এসে বন্ধুদের কত যে গপ (গল্প) শোনাতাম। কিন্তুু নতুন জামা দেখাতাম না। কারণ নতুন জামা দেখালে ঈদ হবে না।
ঘুমাতে যাওয়ার সময় নিজের নতুন জামা দেখতাম আবার ঘুম থেকে উঠে দেখতাম। খেলাধুলা করে এসেও আবার চেক করতাম। আর প্রহর গুনতাম কবে রোজা শেষ হয়ে ঈদের চাঁদ দেখব।
আমাদের আনন্দ দিতে চাঁদ মামা যখন আকাশ উঁকি দিত। তখনই দল বেঁধে হৈ হুল্লোড় আবার বড়দের সাথে মিছিলেও যেতাম। তারা দল বেঁধে ঈদের গান গাইতেন- অ মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই শোন আসমানি তাকিদ।
তারপর শুরু হত মেহেদী দেয়ার পালা। আমার বড় বোন সুন্দর করে মেহেদী একেঁ দিতেন, অবশ্য এ জন্য সিরিয়াল ধরতে হতো। প্রায় ঈদেই আমরা মেহেদী দিয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে উঠে শুকনো মেহেদী তুলে একে অপরের সাথে তুলনা করতাম। কারটা বেশি সুন্দর হইছে।
সকাল সকাল গোসল করতে যেতাম। সেখানেও এক রকম হৈ হুল্লোড়। শহর আর গ্রামের বন্ধুরা সব একসাথে হয়ে মেতে উঠতাম আনন্দে। বল উড়াউড়ি,লাই খেলাসহ নানান খেলা চলত। বাবা মায়েদের ধমকে গোসল শেষ হত।
এবার সবাই সেই কাঙ্খিত ঈদের পোশাক। আহা কি আনন্দ। ঈদের জামার পরার মাঝে যে কত সুখ বয়ে যেত তা কি এ বয়সে বুঝিয়ে বলা সম্ভব?
ঈদের পোশাক পরে যেতাম বাবা,মা,জেঠার কাছে। সবাই ঈদের সালামি দিতেন। দল বেঁধে আমরা ঈদগাহে যেতাম। সেখানে হরেক রকমের দোকানিরা নানান খেলনা ও মুখরোচক খাবার বিক্রি করতেন। তবে আমরা হোটকা আর বাঁশিই ক্রয় করতাম। হোটকার মাথায় বাঁশি লাগিয়ে এটাকে ফুলিয়ে বড় করতাম। তারপর আস্তে করে ছেড়ে দিতাম। তখন নিজে নিজেই বাঁশি বাজত। সারা পাড়া জুড়ে এই বু বু আওয়াজই হতো।
মা ডাকতেন খাবার খেতে কিন্তুু নতুন পোশাক পরে বন্ধুদের সাথে খেলা ছেড়ে খাবার খেতেও ভাল লাগত না। যদিও হরেক রকমের খাবার তৈরি হত।
এ দিনে চাচি জেঠীরাও জোর করে তাদের ঘরে নিয়ে যেতেন খাবার খেতে। বিকেল গড়ালে আত্মীয় স্বজনরা সব একসাথে হত। কতদিন পর সবার সাথে দেখা। কত হাসি খুশি আর আনন্দের ভাগাভাগি চলত।
অবশ্য নতুন মেহমানরা এলে আমাদেরও পকেটে ঈদ সালামি পড়তো। এতে আনন্দ আরো বেড়ে যেত।
ঈদের পর দিন তারপর পরদিনসহ কয়েকদিন ঈদের আনন্দে মেতে থাকতাম। এদিক ওদিক বেড়াতে যেতাম। কিন্তু সে আনন্দ স্থায়ী হয় না। ফিরে যেতে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মন পড়ে থাকে বাড়িতে ঈদের আনন্দে।
লেখক: সংবাদকর্মী।