৫০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি, ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ
শত বছরের ঠান্ডা কালিবাড়ির মেলা
তৈয়বুর রহমান সোহেল।।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ঐতিহ্যবাহী ঠান্ডা কালিবাড়ি মেলা। প্রায় শত বছর ধরে চলমান জেলার সবচেয়ে বড় এই মেলার জৌলুস একটুও কমেনি। বরং দিন দিন এর কলেবর বাড়ছে। বেড়েছে লোক সমাগম। মেলায় চলতি বছরও (মূল মেলাস্থলে) লক্ষাধিক লোকের সমাগম হতে পারে বলে ধারণা আয়োজকদের। এদিকে মেলার আগে মাটির ঘরে লেপ দেওয়া হয়। ঘর সাজানো হয়। জামাই বেড়াতে আসেন শ্বশুর বাড়িতে ।
জলাবেষ্টিত হাসানপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে রেললাইনের ধারে মোগরা গ্রাম। এখানে প্রতি বছর পয়লা মাঘ মেলাটি বসে। মেলার দিন পুরো নাঙ্গলকোটে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। এদিন উপজেলার প্রায় সবগুলো বাজারেও একরকম মেলার আবহ বিরাজ করে। ওইসব বাজারে মূল মেলার মতো সামুদ্রিক ও দেশি মাছে ভরপুর হয়ে যায়। খেলনা সামগ্রী ও অন্যান্য পণ্যের স্টল বসে। মেলার মূল অংশ ও অন্যান্য মিলিয়ে শুধুমাত্র মাছই বিক্রি হয় ৫০ কোটি টাকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে ধারণা বিক্রেতাদের।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) ঠান্ডা কালিবাড়ি মেলায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চারদিকের রাস্তা ধরে হাজার হাজার মানুষ মেলায় প্রবেশ করছেন। শিশু-কিশোররা বুবুজলা বাজিয়ে সরগরম রাখছে মেলার পরিবেশ। মেলায় খেলনার পসরা। জিলাপি-মোয়া কেনায় ব্যস্ত কেউ কেউ। কেউ মাতোয়ারা নাগরদোলায়। মাছ দোকানে দাম হাঁকডাকে ব্যস্ত ক্রেতারা। ১৫-২০ কেজি ওজনের কোরাল, সুরমা, বোয়াল, কাতলা আর রুইয়ে ভরপুর মেলা প্রাঙ্গণ। অন্যান্য বছরের তুলনায় মেলায় নারী দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। আয়োজক, পুলিশ ও গ্রাম পুলিশ মেলার পরিবেশ ঠিক রাখতে ব্যস্ত।
হাসানপুর গ্রামের মাছ বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, আমি গত ৩০ বছর ধরে এই মেলায় মাছ বিক্রি করি। বিকেলে মাছ বিক্রির ধুম পড়ে। মেলা ও এর আশেপাশে প্রায় ২০০ দোকানি বসে। গড়ে বিক্রি হয় ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া পুরো উপজেলাতেও মেলাকে উপলক্ষ করে মাছ বিক্রি হয়। মূল মেলায় জায়গা না হওয়ায় বিক্রেতারা বাজারগুলোকে বেছে নেন। এটা মেলারই অংশ।
উপজেলার রায়কোট গ্রামের সামুদ্রিক মাছ বিক্রেতা ফয়েজ উল্লাহ বলেন, চট্টগ্রামে ফিশারি ঘাট থেকে আমরা মাছ সংগ্রহ করি। মেলা ঘনিয়ে আসার কিছুদিন আগে থেকে মাছ সংগ্রহ শুরু হয়। মাছ বড় হওয়ায় দাম বেশি পড়ে। তাছাড়া বড় মাছ কেনার জন্য এদিন মানুষজন মুখিয়ে থাকে।
ঢালুয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এই মেলার সাথে নানাভাবে যুক্ত আছি। মেলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মৌসুমী ব্যবসা করি।
জিলাপি বিক্রেতা আবুল কাশেম জানান, মেলার দিন একটি দোকানে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দুই টন জিলাপি বিক্রি হয়। দুপুরের পর দম ফেলার সময় থাকে না।
মেলার আয়োজক কমিটির সদস্য জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, এ বছরও মেলায় লক্ষাধিক লোক সমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে। মেলার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। মেলায় স্বেচ্ছাসেবী ও পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
ঠান্ডা কালিবাড়ি মেলার ইতিহাস
উপজেলার জিনিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা আবুল খায়ের ভেন্ডার বলেন, আমার বয়স ৭৮। এ মেলার আয়োজন হতো মূলত পৌষ মাসের শেষে। বাবা-দাদাদের মুখে শোনা, মেলার পাশে বটগাছ ছিল। সেখানে পূজা-অর্চনা হতো। পূজা শেষে ঠাকুরদের উপঢৌকন হিসেবে মাছ ও মিষ্টান্ন দেওয়া হতো। ওই স্থানেই একসময় মেলা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর এই মেলা মাঘ মাসের ১তারিখ ধার্য করা হয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি মেলাটি দেখে আসছি।
কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ১৯৬৭ কিংবা ১৯৬৮ সালে আমি প্রথম এই মেলায় যাই। মেলার স্থান আজও বদলায়নি। বাবা-দাদারাও ঠান্ডা কালিবাড়ি মেলার কথা বলেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও এ কথা বলা যায়, মেলার বয়স শত বছর পেরিয়ে গেছে। মেলার আগে মাটির ঘর লেপ দেওয়া হতো। ঘর সাজানো হতো পরিপাটি করে। জামাইয়রা শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে আসতেন। মেলাকে ঘিরে এখনো সে আমেজটা রয়ে গেছে।
কথিত আছে, উপজেলার মোগরা গ্রামের উপেন্দ্র চন্দ্রের বাড়িতে ধর্মীয় কার্যক্রম চলতো। বাড়িটির নাম কালিবাড়ি। আর ঠান্ডার দিনে মেলার আয়োজন করা হতো বলে এর নাম হয় ঠান্ডা কালিবাড়ি। কালক্রমে ওই গ্রাম থেকে উপেন্দ্র চন্দ্ররা চলে গেলেও মেলা চলতে থাকে। মাঝে করোনার কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে মেলাটি বন্ধ ছিল।
কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, কুমিল্লার অনেক মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এ মেলাটি দীর্ঘ বছর ধরে টিকে আছে। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হবে।
নাঙ্গলকোট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বলেন, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবারও আমরা মেলার ইজারা ডেকেছি। মেলার পরিস্থিতি স্বভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি সেনবাহিনীও মোতায়েন রয়েছে। মেলায় এবারও বিপুল মানুষের সমাগম হচ্ছে।