ন্যায়ের নামে অন্যায়ের উন্মাদনা

মনোয়ার হোসেন রতন।।

বর্তমান বাংলাদেশে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির মাধ্যমে বিচার। এটি কোনো আইনসঙ্গত পন্থা নয় বরং অন্ধ প্রতিশোধ ও গুজবের উন্মাদনায় ভেসে যাওয়ার নাম। যেখানে ব্যক্তি বা জনতা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে কোনো অপরাধের সন্দেহে কাউকে শাস্তি দেয়—পুলিশ, আদালত, তদন্ত—সব কিছু উপেক্ষা করে। অথচ সভ্য সমাজে ন্যায়বিচারের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে নিরপেক্ষ বিচার ও আইনি প্রক্রিয়া।
মব জাস্টিস কী এবং কেন এটি ভয়াবহ?
মব জাস্টিস মূলত জনতার হাতে ত্বরিত প্রতিক্রিয়া, যার ভিত্তি হয়ত একটি সন্দেহ, গুজব কিংবা উত্তেজক উসকানি। এটি শাস্তির নামে এমন এক উন্মাদনা, যেখানে সঠিক-ভুলের হিসাব থাকে না। বরং মুহূর্তের উত্তেজনায় একজন মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়—যিনি হয়তো নির্দোষ, কিংবা অপরাধ প্রমাণ হয়নি।
এই প্রক্রিয়ায় কোনো ফরেনসিক তদন্ত নেই, নেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, বরং আছে গণধোলাই, রক্তপাত এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু। আর একেকটি প্রাণ হারানোর সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায় বহু পরিবার, জন্ম নেয় সামাজিক ভীতি ও অসহনশীলতা।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় মব জাস্টিস
আমাদের সমাজে বিচারহীনতা, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, পুলিশের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং আইনের প্রতি অনাস্থা—সব মিলিয়ে জনগণ কখনো কখনো “নিজেরাই বিচারক” হয়ে ওঠে। এর সাথে যোগ হয় সামাজিক অজ্ঞতা, গুজব, আর উগ্র আবেগ।
নিচে ভয়াবহ উদাহরণ তুলে ধরা হলো:
—তাসলিমা বেগম রেণু হত্যা (২০১৯)
ঢাকার উত্তরায় এক সকালে সন্তানকে ভর্তি করাতে গিয়ে ‘শিশু চোর’ সন্দেহে শতাধিক মানুষের হাতে নির্মমভাবে গণপিটুনির শিকার হন তাসলিমা রেণু। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত মা এবং মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। পরবর্তীতে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই সত্য ছিল না। এই ঘটনাটি গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দেয়।
গুজব ও ধর্মীয় উসকানি:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া পোস্ট ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার নজিরও বাংলাদেশে দেখা গেছে। রামু, ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগরের ঘটনা আজও স্মরণীয়—যেখানে একটি ভুয়া পোস্টের জেরে বহু ঘরবাড়ি, মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
চুরির সন্দেহে হত্যা:
সাধারণ গ্রামে অথবা শহরের অলিগলিতে চুরির অভিযোগে অনেক সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়, অপরাধের কোনো সত্যতা ছিল না।
কারণসমূহ:
*আইনের দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্বলতা
*জনগণের আইনের ওপর আস্থার অভাব
*গুজব, সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার
*জনসচেতনতার ঘাটতি
*রাজনৈতিক প্রভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি
প্রতিকার ও করণীয়:
*বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা – মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হলে মানুষ নিজ হাতে বিচার নেওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসবে।
*আইনের কঠোর প্রয়োগ – যারা মব জাস্টিসে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।*জনসচেতনতা বৃদ্ধি – স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মিডিয়া—সর্বত্র প্রচার করতে হবে যে গুজব ও মব জাস্টিস অপরাধ।
*সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং ও ডিজিটাল সচেতনতা – গুজব ছড়ানো, হিংসা উসকে দেওয়ার মতো কার্যক্রম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
*পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ত্বরিত হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা।
একটি সভ্য রাষ্ট্রে বিচার করতে পারে কেবল আদালত। ‘ন্যায়ের নামে অন্যায়’ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নির্দোষ মানুষ যখন মব জাস্টিসে প্রাণ হারায়, তখন কেবল একটি জীবনই নয়, ধ্বংস হয় সমাজের মানবিক চেতনাও।
তাই এখনই সময়—গণপিটুনির উন্মাদনা রুখে দিয়ে আইন ও মানবাধিকারের শাসন নিশ্চিত করার। ‘গুজবে কান দেবেন না, আইন নিজের হাতে নেবেন না’—এই বোধ গড়ে তোলা জরুরি।
*মব জাস্টিস নয়, চাই আইনের শাসন।*গুজব নয়, চাই সত্য তথ্য ও সচেতনতা।*ন্যায়বিচার হোক প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার আশ্বাস।