৬৪ জেলার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রূপরেখা

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেই মুক্তি:

inside post

মনোয়ার হোসেন রতন।।
 একটি রাষ্ট্রের প্রাণ কেন্দ্রীভূত নয়—বিকেন্দ্রীকৃত হয়। বাংলাদেশ তার উন্নয়নের যাত্রায় সেই মৌলিক সত্য থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। কেন্দ্রভিত্তিক রাষ্ট্রপরিচালনার ভারে যেমন ঢাকার মৃত্যু ঘটছে, তেমনি পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশের ৬৪টি সম্ভাবনাময় জেলা।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আজ আর স্বপ্নের শহর নয়, বরং অতিরিক্ত চাপ ও অব্যবস্থাপনার বোঝা নিয়ে ধুঁকতে থাকা এক বিভীষিকাময় নগরী। শহরটির ওপর যে জনসংখ্যা, সেবা, পরিবেশ ও প্রশাসনিক চাপ—তা দিনকে দিন এ নগরীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। যানজট, দূষণ, আবাসন সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নাগরিক পরিসেবার অভাবে ঢাকা আজ নাগরিক জীবনের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।

এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে শুধুমাত্র রাজধানী স্থানান্তর নয়, চাই ব্যবস্থাগত রূপান্তর—যার মূল উপাদান হবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

একটি রাষ্ট্র, ৮টি হৃদয়: বিভাগভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণঃ

বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ—প্রতিটিই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও শক্তির আধার। এই বিভাগ গুলোকে কেবল প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং বিশেষায়িত উন্নয়নের স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

  • ঢাকা: প্রশাসনিক কার্যক্রম, ঐতিহ্য ও সমন্বয় কেন্দ্র
  • চট্টগ্রাম: বন্দরনগরী, ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব ও বাণিজ্যিক রাজধানী
  • রাজশাহী: শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি আম ও কৃষি শিল্প
  • খুলনা: পরিবেশবান্ধব শিল্প ও নৌবাণিজ্য
  • সিলেট: প্রবাসী আয়, চা শিল্প ও পর্যটন
  • বরিশাল: নদী সম্পদ, মাছ প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষি
  • রংপুর: খাদ্য নিরাপত্তা ও শস্যভাণ্ডার
  • ময়মনসিংহ: কৃষি ও প্রাণিসম্পদ গবেষণার কেন্দ্র

প্রতিটি বিভাগ যদি স্বনির্ভর ও উৎপাদনশীল ইউনিটে পরিণত হয়—তবে জাতীয় উন্নয়ন হবে আত্মনির্ভর, গভীর ও বিস্তৃত।

৬৪ জেলার ৬৪টি স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার কথাঃ

প্রতিটি জেলা তার ভৌগোলিক, জনশক্তি, সম্পদ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে একেকটি উদ্ভাবনী ও উন্নয়ন কেন্দ্র হিসেবে। নিচে কিছু বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:

  • কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি: আন্তর্জাতিক পর্যটন, ইকো-ট্যুরিজম ও পাহাড়ি অর্থনীতি
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ: আম, চাল ও কৃষিপণ্য ভিত্তিক রপ্তানি শিল্প
  • গাজীপুর, নরসিংদী: হাইটেক পার্ক, ভারী শিল্প ও ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন
  • যশোর, মাগুরা: আইটি, সফটওয়্যার ও স্টার্টআপ জোন
  • সিলেট, মৌলভীবাজার: চা শিল্প, রেমিট্যান্স ও হেরিটেজ পর্যটন
  • পাবনা, সিরাজগঞ্জ: কৃষিভিত্তিক শিল্প ও টেক্সটাইল হাব
  • কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা: লোকসংগীত ও সংস্কৃতি কেন্দ্র
  • বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা: ইলিশ প্রক্রিয়াজাতকরণ, নৌ-অর্থনীতি
  • ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম: খাদ্যশস্য উৎপাদন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা
  • ময়মনসিংহ, শেরপুর: কৃষি গবেষণা, প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন
  • বাগেরহাট, সাতক্ষীরা: সুন্দরবন নির্ভর পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি
  • চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল: কৃষিশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের পল্লী
  • ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ: নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগ ও মৎস্যখামার
  • রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ: সেতুবন্ধন, পণ্য পরিবহন ও কৃষি উৎপাদন কেন্দ্র

এভাবে প্রতিটি জেলার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা গড়ে তুলতে পারি ৬৪টি শক্তিশালী উন্নয়ন কেন্দ্র—যা হবে একটি বাস্তবভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণের মডেল।

নতুন রাজধানী: একটি নতুন দর্শনের প্রতীকঃ

বিশ্বের বহু দেশ রাজধানী স্থানান্তরের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকাশের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া, নাইজেরিয়ার আবুজা, ইন্দোনেশিয়ার নুসান্তারা এর দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের জন্যও একটি পরিকল্পিত, সবুজ, পরিবেশবান্ধব ও কেন্দ্রস্থিত রাজধানী গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। নতুন রাজধানীর গুণাবলী হওয়া উচিত—

  • ভৌগোলিকভাবে দেশের মাঝামাঝি
  • বন্যামুক্ত উঁচু অঞ্চল
  • সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন
  • প্রযুক্তিনির্ভর এবং আধুনিক অবকাঠামোগত
  • প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ ও বাসযোগ্য

এটি কেবল একটি নতুন নগরী হবে না—এটি হবে রাষ্ট্রের নতুন দর্শনের প্রতীক

এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্তেরঃ

আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। সময় এসেছে পুরনো কাঠামোর জীর্ণতাকে বিদায় জানিয়ে একটি মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার। বিকেন্দ্রীকরণ কেবল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাহিদা নয়—এটি অস্তিত্বের সংগ্রাম, জাতীয় পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি।

৬৪টি জেলা মানেই ৬৪টি হৃদস্পন্দন।
ঢাকার বাইরে যে বাংলাদেশ, তার মুক্তিই জাতির মুক্তি। একটি শহর নয়, চাই সমগ্র জাতির সমান অধিকার। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মানেই উন্নয়নের বিকেন্দ্রীভবন। এখনই সময় একটি নতুন ইতিহাস লেখার।

আরো পড়ুন