অপার সম্ভাবনার ডাকাতিয়া; অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
ডাকাত শব্দটি আঁতকে উঠার। কিন্তু ডাকাতিয়া শব্দটিতে রয়েছে মায়ার বন্ধন, অনেক আদুরে, অনেক গ্রহণযোগ্য দুষ্টুমিভরা মা-খালাদের ডাক। নামকরণ নিয়ে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে- ঐতিহাসিক ভাবে এটি সত্য যে জলদস্যুবৃত্তিতে একসময় ত্রিপুরার মগ উপজাতি ও ফিরিঙ্গিরা বিখ্যাত ছিল। এ নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার নদীর অংশে এবং নদীর অববাহিকায় ডাকাতি করত এবং পরে আবার নদী দিয়েই নিজস্ব আস্তানায় ফেরত যেত। এ দস্যুবৃত্তির কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য কারণ হচ্ছে-বর্ষাকালে অজ¯্র জলরাশির করাল গ্রাসে দুপাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাতো। ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ এমনকি পালিত পশু সমূহও নদীর ¯্রােতে ভেসে গিয়েছে, হারিয়েছে সর্বস্ব। জীবন বাঁচাতে নদীটি পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন খোয়াতে হয়েছে অনেককে। ডাকাতের মত সর্বগ্রাসী রুপ ছিল বলে নামাঙ্কিত হয়েছে ডাকাতিয়া।
ডাকাতিয়া ভারত-বাংলাদেশের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ হয়ে বাগমারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৬৭ মিটার (২২০ ফুট) তবে এলাকাভেদে প্রস্থের বাড়তি কমতি লক্ষণীয়। অনেক খাল তার প্রবাহে মিশেছে এবং সবশেষে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। যার জন্য তাকে মেঘনার একটি উপনদীও বলা হয়। নদীটি কুমিল্লার লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুরের মেঘনায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সাপের মত আঁকাবাঁকা হয়েই নদীটি প্রবাহিত।
বর্ষায় ডাকাতিয়া তার অপার সৌন্দর্য্যে ফিরে আসে। ডাকাতিয়ার লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ অংশের বেশির ভাগ স্থান এখন ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য আনন্দের ঠিকানা। আকাশের বিভিন্ন রূপ ডাকাতিয়ার ছলছলাৎ পানির উপর একটি রূপসী সাজে সেজে উঠে। পানিতে যখন নদীটি টইটুম্বুর তখনই সেটা নয়নাভিরাম এবং তখনই নৌকা নিয়ে বেড়াতে আসে দুপাড়ের বাসিন্দা ও শহরবাসীরা। অনেকে দল বেধে বেড়াতে নামে বিভিন্ন দিকে। অনেকে নদীর বুকেই ভোজনের আয়োজন করে বনভোজনের মত। রাতের শীতল বাতাস ও ডাকাতিয়ার গর্জনে দুপাড়ের মানুষজনকে উদ্বেলিত করে তোলে। নদীর মৎস্য সম্পদ এলাকার লোকজনের আমিষের যোগান দেয় এবং অন্যান্য মাছের চেয়ে অত্যন্ত সুস্বাদু। বোরো মৌসুমে নদীতে থাকা পানি সেচকাজে কৃষকের চাহিদা পূরণ করে।
সম্পদ, অপার সম্ভাবনা ও অপরূপ সৌন্দর্যে মনলোভা ডাকাতিয়া বর্ষায় সকলের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিলেও শীত আসার সাথে সাথে তার সৌন্দর্য্য লোপ পেতে থাকে, পানি কমতে থাকে। এক ধরনের ভূমিদস্যুরা পাড় দখল ও মাটি কাটায় ব্যস্ত হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্থানে কলকারখানার আবর্জনা ও দূষিত বর্জ্য ফেলে বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে নদীর পানিকে। দুই তীরের বসতবাড়ি থেকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, মশা মাছি বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা মাকড়ের উপদ্রব দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘদিন যাবত খনন কার্য চালু না থাকায় অনেক স্থানে ডাকাতিয়া মরা খালে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নদী এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণপিপাসুরা।
এদিকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন নর্দমার পানি এবং সমগ্র কোতয়ালী থানা ও সদর দক্ষিণের সকল বন্যা ও বৃষ্টির পানি বিভিন্ন খালের মাধ্যমে ডাকাতিয়াতেই গিয়ে পড়ে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন থেকে ঘুংগাইজুরী খাল দিয়ে এবং ইপিজেড এর ড্রেন দিয়ে নর্দমার পানি প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে ডাকাতিয়ায় যায়। তাই দুটি পরিশোধনাগারের একটি ইপিজেডে আছে কিন্তু ঠিকমত কাজ করানোর ব্যবস্থায় নজর দিতে হবে। ঘুংগাইজুরীর উপর একটি নতুন পরিশোধনাগার বসাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কোতয়ালী ও সদর দক্ষিণের সকল খালসমূহের গভীরতা ও প্রশস্থতার সঠিকতা বজায়ের ব্যবস্থা করে দখল ও দূষণমুক্ত ড্রেনেজ সিস্টেম শুরু না করলে শুধু যে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনই দূষণে ভরপুর হবে তা নয়, ডাকাতিয়াও হয়ে উঠবে আরও বেশি দূষণীয়।
সম্ভাবনাময় ডাকাতিয়ার লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জের অংশের নদীকে দখল ও দূষনমুক্ত করার নিমিত্তে খননকাজ সম্পন্ন করে বছর জুড়েই দর্শনীয় ও সম্পদশালী করে রাখার জন্য স্থানীয় লোকজন দাবি জানিয়ে আসলেও এ বিষয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। হাইকোর্টের রায়টি কার্যকর করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডি বিভাগ সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেই ডাকাতিয়ার খনন ও দখলমুক্তকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে বলে এ অঞ্চলের সকল পরিবেশবাদীরা মনে করেন। লাকসাম পৌরসভা এলাকার কিছু খালও এসে ডাকাতিয়ায় মিশেছে সেগুলোও দখলমুক্ত করে ডাকাতিয়ার সঙ্গে একটি হাতিরঝিলের মত দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প গ্রহণ করলে লাকসাম আঞ্চলটি সম্পদশালী ও দূষণমুক্ত হয়ে উঠবে। বৃহত্তর লাকসামের উপজেলা পরিষদসমূহ তাদের এলাকার এমপি তথা এলজিইডি মন্ত্রীকে এব্যাপারে সক্রিয় করতে পারলেই ডাকাতিয়া সম্পদশালী হয়ে উঠবে। যোগাযোগ, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে বৃহত্তর লাকসামের জনগণ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।
সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল।