কলমি লতার ফাঁকে নেভিব্লু আকাশে চাঁদ উঁকি মারে!

।। ইলিয়াছ হোসাইন।।
চিকন চাঁদটা দেখার জন্য সবাই পুকুরের পূর্ব পাড়ে আমরা ভিড় জমাতাম। কলমি লতার ফাঁকে উঁকি মেরে নেভিব্লু রঙের আকাশটায় চাঁদ হাসি দিয়ে থাকতো। টিভিতে ঘোষণার আগে পুকুর পাড়ের চিৎকার শুনে বুঝা যেতো ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকাল রোজার ঈদ। বাজার থেকে আনা ২টাকা দরের রঙিন কাগজের টুপি,পাঞ্জাবি,সেন্ডেল বার বার খুলে দেখতাম। সবাইকে দেখাতাম। নতুন জামা-কাপড় ঈদের আগে দেখলে ঈদ হবেনা বলে তা আবার লুকায়ে রাখতাম। ঈদের আগের দিন রাতে ঘুমাতাম না। কুসুম আপু, আমার জেঠাতো বোন। ওনি সবার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতেন। পাড়ার সকল ছেলে-মেয়েরা আপুর কাছে ভিড় জমাতো। আপু ছাড়া আমাদের বাড়ির কেউ আর মেহেদী লাগাতে পারতোনা। তখন টিউবের মেহেদি বাজারে বের হয়নি। পাটায় ভাটা মেহেদী দিয়েই কাঠির আগায় নিয়ে নিয়ে হাতে নকশা করতেন আপু। গাছের মেহেদী পাতা। রঙ ধরতে যেমন সময় নিতো,রঙ উঠতেও অনেক সময় নিতো। একজনের পর একজন বসতো,পুরো রাত মেহেদী রঙের আনন্দে কেটে যেতো। বড় হয়ে উপলব্ধি করতে পারি গাছের মেহেদী পাতার রঙের সাথে শৈশবের সম্পর্কগুলোর গভীর মিল আছে,পাটায় ভাটা মেহেদী রঙের মতো শৈশবের সম্পর্ক গুলো অনেক বছর ধরে টিকে থাকে। আর বাজারের টিউব মেহেদি আর বর্তমান সম্পর্কগুলো হচ্ছে এক- গড়ে যেমন তাড়তাড়ি,ভাঙ্গেও তাড়তাড়ি!

২.
ঈদের দিন! শার্ট প্যান্ট,কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে ঈদগাহে চলে এলাম। মসজিদের মাঠটা ছোট বেলায় অনেক বড় দেখেছি। এখন যতো বড় হচ্ছি ততোই এই মাঠ ছোট হচ্ছে। কাগজের ভেতর খের(খড়) ঢুকিয়ে ফুটবল খেলতাম আমরা এই মাঠেই। প্লাস্টিকের দু’টাকা দামের ক্রিকেট বল আর তালের গোদা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলতাম ক্রিকেট। স্ট্যাম্প হতো ইটের কণায় টানা দেয়ালে কমলা রঙের তিনটা দাগ।
তখন পড়া ভালো লাগতো না,শুধু খেলা ভালো লাগতো। দুপুরের কড়া রোদও তখন কড়া লাগতনা।
সবাই ঈদগায়ে নতুন জামা পরে বসে আছে। পুরো মাঠ সাদা রঙের পবিত্রতায় ভরপুর। দু’টাকা করে সালামি পেতে পেতে অনেক টাকা হয়েছে। প্রায় ৪০টাকা, পকেট ভর্তি টাকা। ঈদের নামাজ শেষ। রাসেলকে নিয়ে মহেশপুর বরিগ্গা(বৈরাগীর)বাজার লুব্বুলার(জুলফে আলী) দোকানে চলে গেলাম। ৫টাকা দিয়ে জিপ গাড়ি কিনেছি। সুতা বেঁধে বাজার থেকে বাড়ি পর্যন্ত টেনে চালিয়ে নিয়ে এসেছি। এখনকার দামী মটরকার খেলনার চেয়ে আমাদের সুতো টানা জিপগাড়ির আনন্দ সেরা ছিলো!
রাসেল আমার জেঠাতো ভাই,সেই ছিলো ছোট বেলার একমাত্র সর্বক্ষণের বন্ধু। এখন বড় হয়ে গেছে। ছেলে-সন্তান-বউ হয়েছে;আমাদের বন্ধুত্বের দূরত্বও বাজারের টিউব মেহেদীর মতো হয়ে গেছে।

৩.
ঈদের দিন। সবাই খুশি। সবাই ডেকে ডেকে নিয়ে সেমাই খাওয়ায়। এ আপ্যায়ন ঈদ ছাড়া খুব কমই দেখা যায়। মা-চাচিরা বা চাচা-জেঠারা যারা ঝগড়া করতো, তারপর রাগ করে পরস্পর তারা কথা বলতোনা। কিন্তু ঈদের দিন দেখতাম সবাই কথা বলছে, একজন আরেকজনের সাথে কোলাকুলি করছে হাসি মুখে;আমি চোখের পানি ছেড়ে খুব অবাক হতাম। খুব ভালো লাগতো এই ব্যাপারটা। আমি মনে মনে দোয়া করতাম আল্লাহ যদি এমন ঈদ মানুষকে প্রতিদিন দিতো তাহলে হয়তো মানুষে মানুষে আর রাগ করে থাকতো না। ঝগড়া করলেও রাগ ভেঙে সবাই সবার সাথে কথা বলতো। চাচা-জেঠাদের আত্মার দূরত্ব তৈরি হতোনা!

৪.
ঈদের দিন বিকেল বেলা। ভিটিতে ঈদের ছবি দেবে। সাদা-কালো টেলিভিশন। সবাই ছুটোছুটি করে কালা মিয়ার ঘরে( শরীফ ভাই), লতিফ মাস্টারের বাড়ি,জামাল জেঠার ঘরে,ছুটে যেতাম ঈদের ছবি দেখতে। গ্রামে টিভি সবার ছিলো না,তিন-চারটে ঘরে ছিলো। এই তিনটে ঘরে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের শুধু টিভি দেখার সুযোগ ছিলো। এক কোণে বসে লুকিয়ে দেখতাম। কেউ যদি এসে ডেকে নিয়ে যায়। ৫টাকা দরের প্রাণ খেতাম আর টিভি দেখতাম। এখন ঘরে ঘরে স্মার্ট টিভি,এতো এতো চ্যানেল,শত শত মুভি। কিন্তু সেই শৈশবের এক চ্যানেলের বিটিভি দেখার আমেজ-আনন্দ এখনকার ছেলে-মেয়েরা অবশ্যই পায় না।

৫.
ঈদ শেষ! সারাদিন আনন্দ করে সন্ধ্যায় ক্লান্ত! গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সন্ধ্যা ৭টায় ঘুমিয়ে যায়। রাত যতো বাড়তে থাকে ঘুম ততো গভীর। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নের মধ্যে সারাদিনের ঈদ আনন্দ সৃষ্টিকর্তার মহান কুদরতে আরো একবার ‘হাইলাইটস’ দেখার সুযোগ হতো! গ্রামের ছেলেরা খুব তাড়তাড়ি ঘুমায় বলে ওদের মস্তিষ্ক সব সময় সচল থাকে। শহরের পোলাপানরা এ সুযোগ পায় না। তবে এখন আর আমাদের শৈশবের সেই গ্রামীণ ঘুম আর গ্রামীণ ভোরটা এ যুগের গ্রামীণ স্মার্ট বাচ্চারা পায় না। কারণ এ যুগের স্মার্ট ফোন এসে আমাদের শৈশবের শান্তির ঘুম আর শান্তির ভোরটাকে স্মার্টভাবে গ্রাস করে নিয়ে গেছে!
লেখক: আলোকচিত্রী ও সংবাদকর্মী।