কুমিল্লার কোচিং সেন্টারের হালচাল

স্কুলে পড়লে তালপুকুর কলেজে পড়লে রাণীর দিঘির পাড়!
মহসীন কবির।।
অ্যাকাডেমিক ফলাফলকে আরও সুদৃঢ় করতে প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসের বাইরে প্রাইভেট টিউটর ও কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হন অনেক শিক্ষার্থী। এছাড়াও স্বনামধন্য স্কুল-কলেজে চান্স পেতে এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে। সারা দেশের ন্যায় কুমিল্লাও কোচিং সেন্টারের যাত্রা শুরু হয় ৯০’র দশকে। কুমিল্লায় একটি কথা আগে থেকেই প্রচলিত আছে- ‘স্কুলে পড়লে তালপুকুর কলেজে পড়লে রাণীর দিঘির পাড়।’ কারণ এই দুই
এলাকায় যথাক্রমে স্কুল ও কলেজের শিক্ষক এবং বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের আধিক্য রয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে নগরীর অলিগলিতেও গড়ে উঠেছে শতাধিক অ্যাকাডেমিক কোচিং সেন্টার। এছাড়াও রয়েছে ঢাকা থেকে পরিচালিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি এবং চাকরি কোচিংয়ের শাখা। তবে শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল বা ক্যারিয়ার গঠনে এসব প্রতিষ্ঠান কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে এ নিয়ে প্রশ্নে উঠেছে। কোচিং ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল-কলেজ বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। তাই ঘাটতি পূরণে অনেক অভিভাবক সন্তানদেরকে প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারে দিয়ে থাকেন। তবে এ কথাও
সত্য সরকার ক্লাস পরীক্ষা পদ্ধতি সীমিত করে দেয়ায় আগের চেয়ে কোচিং নির্ভরতা কমেছে। এমনটি বলছেন মালিকপক্ষ।
অভিভাবকদের অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকটি বাদে অধিকাংশ কোচিং সেন্টারই মানহীন। পরিবেশ ঘিঞ্জি ও স্যাঁতস্যাঁতে। আবার অনেকগুলো নির্জন এলাকায়। নেই ভালো মানের শিক্ষক। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজরদারি করতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।
আর ব্যক্তি মালিকানাধীন কোচিংয়ের বাইরেও বিভিন্ন সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষকও জড়িত রয়েছেন কোচিং সেন্টারের সাথে। অবশ্য এমনটি প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জেলা শিক্ষা শিক্ষা অফিসার।
কুমিল্লায় সক্রিয় যেসব কোচিং সেন্টার নগরীর তালপুকুরপাড়,রাণীর দিঘির পাড়, ঝাউতলা, নজরুল এভিনিউ, দিগম্বরী তলা, রেইসকোর্স, লাকসাম রোড, ঠাকুরপাড়া ও টমছম ব্রিজ এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে শতাধিক কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানান সেখানে মূলত প্রথম থেকে-একাদশ পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন বিষয় পড়ানো
হয়। এছাড়াও জিলা স্কুল, নবাব ফয়জুন্নেসা এবং মডার্ন স্কুলে ভর্তির গাইডলাইন দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- কুমিল্লা ই.হক কোচিং, এবিসি অ্যাকাডেমি, জিনিয়াস এডুকেয়ার, তালুকদার অ্যাকাডেমি, কুমিল্লা উদ্ভাস অ্যাকাডেমিক কেয়ার, ব্রাইট
ফিউচার, লার্নার্স কেয়ার একাডেমি, ট্যাবস, গুরুকুল, মীম কোচিং সেন্টার, বর্ণমালা ক্যাডেট অ্যাকাডেমি, কুমিল্লা কোচিং, প্রবাহ এডুকেয়ার, পাঠশালা ও স্টুডেন্ট কেয়ার। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য রয়েছে ইউসিসি, ফোকাস, উদ্ভাস এবং
মেডিকেলের ক্ষেত্রে রয়েছে রেটিনা ও মেডিপ্লাসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আর চাকরির জন্য রয়েছে বিসিএস কনফিডেন্স এবং ওরাকল কোচিং সেন্টার।
কোচিং সেন্টার নিয়ে কুমিল্লার কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বছরের বেশিরভাগ সময় শিক্ষা-
প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। তাই নিয়মিত ক্লাস হয় না বলে কঠিন বিষয়গুলো সমাধানের জন্য বিশেষ ক্লাসের প্রয়োজন পড়ে। অনেকটা নিরূপায় হয়ে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে হচ্ছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। মডার্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ফৌজিয়া বলেন- ইংরেজি, গণিত ও
বিজ্ঞান বিভাগের অধিকাংশ বিষয়ই অধিকতর কঠিন। তাই প্রাইভেট বা কোচিংয়ে না গিয়ে উপায় নেই। একই কথা বলেন পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহান। ত্রার মতে নিয়মিত ক্লাসে সিলেবাস সম্পন্ন হলে কোচিংয়ের দরকার নেই। সরকারি
মহিলা কলেজের দ্বাদশের শিক্ষার্থী নূপুর বিশ্বাস বলেন- অধিকাংশ কোচিং সেন্টারের পরিবেশ ভালো নয়। বেশিরভাগই নির্জন এলাকায়। যা ছাত্রীদের জন্য ভয়ের।
ফয়জুন্নেসা স্কুলের অভিভাবক সুমি আক্তার বলেন- অনেক সময় চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ও সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতারণার শিকার হতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান গলাকাটা ফি নিচ্ছে। অথচ সে অনুযায়ী পাঠদান করছে না। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের অভিভাবক মোসলেম খান বলেন-শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে কোচিং সেন্টার চলায় আপত্তি নেই। তবে মানের দিকটাও খেয়াল রাখা জরুরি।
কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম. নার্গিস আক্তার মনে করেন- নতুন কারিকুলামে শিক্ষকরা উদ্যোগী হলে এবং ডিউরেশন ও শিক্ষার্থীদের রেসিও অনুযায়ী ক্লাস হলে কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট বা কোচিংমুখী হওয়ার
প্রয়োজন নেই।
কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন বলেন- কোচিং সেন্টারের কিছু শিক্ষক দুর্বল শিক্ষার্থীদেরকে অতিরিক্ত সময় দিয়ে আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করান। এতে সেই শিক্ষার্থীদের কাছে পড়ালেখা আনন্দদায়ক হতে পারে। তবে কোচিং সেন্টারগুলোকে অবশ্যই একটি নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি। বিশেষ করে কুমিল্লার অলিগলিতে নামে-বেনামে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদারকি করা সময়ের দাবি।
নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা ই.হক কোচিং সেন্টারের পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন- তিনি এক দশকেরও বেশি সময় কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত। তার মতে স্কুল-কলেজে সরকারি ছুটি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশিরভাগ সময়ই ক্লাস বন্ধ
থাকে। তাই সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হন।
ঝাউতলা এলাকার কুমিল্লা উদ্ভাস একাডেমিক কেয়ারের পরিচালক আহসান উল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করতে হলে পরীক্ষা পদ্ধতি সংশোধন করা জরুরি। কারণ এটি রহিত করায় ক্লাস ও কোচিং সবদিকেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট হয়েছে।
রাণীর দিঘিরপাড় এলাকার ট্যাবস কোচিংয়ের পরিচালক সৈয়দ মইনুল ইসলাম বলেন, মূলত অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের বিশেষ কেয়ারিংয়ের জন্যই সন্তানদের কোচিংয়ে দেন অভিভাবকরা। আমরা সে অনুযায়ীই তাদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করি।
ঝাউতলা এলাকার তালুকদার একাডেমির কার্যকরী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বলেন- এ প্রতিষ্ঠানে মূলত ক্যাডেটে ভর্তিচ্ছুদের পাঠদান করা হয়। যে গাইডলাইন অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও পাওয়া যায় না। তার দাবি এখান থেকে প্রতি বছর অনেকেই
ক্যাডেটে চান্স পাচ্ছে। কোচিং নিয়ে সামগ্রিকভাবে তার মন্তব্য হলো- সঠিক নীতিমালা থাকতে হবে।
কুমিল্লার কোচিং ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ও বর্ণমালা ক্যাডেট অ্যাকাডেমির পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন- তার অধীনে প্রায় অর্ধশত কোচিং সেন্টার রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক। নিয়মিত ক্লাস হলে এবং শিক্ষকরা যথাযথ
দায়িত্ব পালন করলে এতো কোচিং সেন্টারের প্রয়োজন হতো না। তিনি স্বীকার করেন নতুন শিক্ষা কারিকুলামের কারণে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী কমেছে।
কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, সরকারি বা এমপিওভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। এ নিয়ে নিয়মিত তদারকিও হচ্ছে। ক্লাসেই পাঠদানের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারপরও কেউ কোচিংয়ে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুমিল্লা জেলার অতিরিক্ত প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ফাহমিদা মুস্তফা বলেন- সরকার কোচিংকে কখনই উৎসাহিত করে না। তারপরও যারা কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন, তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

inside post
আরো পড়ুন